রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ৬টি কমিশনের মধ্যে চারটি কমিশন এরই মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ চারটি কমিশন তাদের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা পেশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
নির্বাচন, রাষ্ট্রক্ষমতা, সংবিধান, রাষ্ট্রের মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনসহ সংস্কার প্রস্তাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই তুলে আনা হয়েছে। দুই হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার বিদায়ের পর রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ে তোলের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবারই বলে থাকেন, ছাত্ররা আমাদের সামনে বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অন্য উপদেষ্টা ও ছাত্র নেতারা নানা সময়ে বলে আসছেন, `শুধুমাত্র একটি নির্বাচন দেয়ার জন্য দুই হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে এই গণ অভ্যুত্থান বা বিপ্লব হয়নি। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পূনর্গঠনের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমরা এমন কিছু সংস্কার করতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে, ন্যায় বিচার পায়। দেশটা যেন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে না পারে। সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি সেক্টরে যে বৈষম্য তৈরি হয়ে আছে, সেসব যেন দূর করা যায়, সে লক্ষ্যে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গুম, খুন, নির্যাতন, দূর্নীতি, মানি লন্ডারিংয়ের বিচার করতে হবে।‘
সমাজের প্রতিটি সেক্টরে যে বৈষম্য তৈরি হয়ে আছে, সেসব যেন দূর করা যায়, সে লক্ষ্যে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গুম, খুন, নির্যাতন, দূর্নীতি, মানি লন্ডারিংয়ের বিচার করতে হবে।
নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে সরকার দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি নির্বাচনের কার্যক্রমও শুরু করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কার করা হবে চারধাপে। যার প্রথম ধাপে গঠন করা হয়েছে সংস্কার কমিশন। ৬টি কমিশন নানা প্রক্রিয়া শেষে তাদের সুপারিশমালা পেশ করেছে বা করবে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খোদ প্রধান উপদেষ্টা এর প্রধান। ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
দ্বিতীয় ধাপের কাজ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কার বিষয়ে আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বেই এই আলোচনা-পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় ধাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। চতুর্থ ধাপে হবে বাস্তবায়ন।
দেখলেই মনে হবে, কত সুন্দর পরিকল্পিত পন্থায়, সুচারুরূপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে, রাষ্ট্র এমন একটা চেহারা লাভ করবে, যে চেহারাটা দেখতে চায় সমস্ত দেশপ্রেমিক জনগন। সুপারিশকৃত এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে অবশ্যই বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, `জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে যে জনআকাঙ্ক্ষা ছিল, তা সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে।‘
চার সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা দেয়ার পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, `কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটিসহ স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি খাতে সংস্কার আনতে পারবো। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের পর সরকার সেটি বাস্তবায়ন করবে।‘
খুব ভালো কথা। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে, দেশের খোলনলচে পাল্টে যাবে। দেশটা আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে ভারসাম্য তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে।
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে, দেশের খোলনলচে পাল্টে যাবে। দেশটা আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে ভারসাম্য তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে।
কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস কী বলে? বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় চরিত্র ব্যাখ্যা করলে কী পাওয়া যাবে? এমনিতেই এই জাতি খুবই ভুলোমনা। এই জাতি ৫ মাস বয়সী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে, উপদেষ্টাদের গোষ্ঠি উদ্ধার করবে। অথচ, কোন অবস্থায়, কী পরিস্থিতিতে এ সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। শেখ হাসিনার অত্যাচার-নির্যাতনের কথা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার কথা সাধারণ মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। মানুষ জানে না শেখ হাসিনার লুটপাট, দূর্নীতি আর অর্থ পাচারের কারণে যে করুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তারই জের টানতে হচ্ছে তাদেরকে; কিন্তু তারা সমালোচনা করা বা গালিটা দেয় বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা বা ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের।
ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার যাতে আর কখনো মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, রাষ্ট্র এবং সমাজের সকল স্তর থেকে যেন বৈষম্য দূর করা যায়- সে লক্ষ্যেই তো ৬টি সংস্কার কমিশন! ধরা যাক, এই কমিশনগুলো যে সংস্কার প্রস্তাব তুলে এনেছে, সেগুলো আলোচনা-পর্যালোচনার পর পাশ হলো, বাস্তবায়ন পুরো হোক কিংবা আংশিক, করে দিয়ে গেলো এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এরপর কী হবে?
এরই মধ্যে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসছে, `সংস্কার করার অধিকার বর্তমান সরকার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকারীদের নেই। সংস্কার করবে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার। ‘শুধু তাই নয়, বিএনপিসহ অনেকেই সংস্কারের নানা টপিক নিয়ে তুমুল বিরোধীতা করছে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, `অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে সংস্কার করা জনপ্রতিনিধিদের কাজ। ছাত্র কিংবা উপদেষ্টাদের সংস্কারের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার নাই। তারা মনে করে ইলেকশন দিলেই তো বিএনপি চলে আসবে। জনগন যদি বিএনপিকে ভোট দেয়, এটা তো আমাদের দোষ না। ‘
শুধু মেজর (অব.) হাফিজ যে মত দিয়েছেন, তা পুরো বিএনপিএরই মত হিসেবে ধরে নেয়া যায়। কারণ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভীর সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোই সেটা প্রমাণ করে। মির্জা ফখরুল সাহেব সংবিধান সংশোধন করতে রাজি নন। রাষ্ট্রপতিকে সরাতে রাজি নন। সংস্কারের অধিকাংশেরই বিরোধীতা করছেন তিনি। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল সাহেব সংবিধান সংশোধন করতে রাজি নন। রাষ্ট্রপতিকে সরাতে রাজি নন। সংস্কারের অধিকাংশেরই বিরোধীতা করছেন তিনি। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এসবের অর্থ হলো, নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ড. ইউনূস সরকার বিদায় নিলে, তখনকার রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক সংসদে বসে মেজরিটি মেন্ডেটের ভিত্তিতে এইসব সংস্কার আমূল বদলে দেয়া হবে! নিজেদের মত করে আবার সব কিছু লেখা হবে, তৈরি করা হবে!
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে সংবিধানে। এই ১৭টি সংশোধনীর কয়টি প্রকৃতই রাষ্ট্র এবং জনগনের স্বার্থে করা হয়েছে? যে সরকার সংবিধান প্রণয়ন করেছিলো, নিজেদের স্বার্থে তারাই তাদের মেয়াদকালে ৪বার সংশোধনী এনেছিল। সর্বশেষ তো সংবিধান সংশোধন (চতুর্থ) করে তারা গণতন্ত্রই হরণ করেছিলো বাকশাল কায়েম করে।
প্রতিটা সংশোধনীরই মুখ্য এবং সুক্ষ উদ্দেশ্য ছিল তখনকার সরকারের ক্ষমতা স্থায়ী এবং নিরঙ্কুশ করার বন্দোবস্ত করা। সংসদে মেজরিটি পেলেই সংবিধান সংশোধনী বিল আনতে হবে- এটা যেন একটা নিয়মে পরিণত করেছিল বিগত সরকারগুলো। ভবিষ্যতেও যে হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? তেমনটা যে ঘটবে, বড় বড় রাজতৈনিক দলগুলোর আচার-আচরণেই তো বোঝা যাচ্ছে।
সুতরাং, আবু সাঈদ-মুগ্ধ থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার মানুষের আত্মদান কী তাহলে বৃথা হয়ে যাবে? সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হবে না? ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য যে চেষ্টা বর্তমান সরকার ও আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা করে যাচ্ছে, সেই চেষ্টা কী বৃথা হযে যাবে? ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের যে জনআকাঙ্খা তৈরি হয়েছে, তা কী বাস্তবায়ন হবে না? পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বহাল থাকলে যে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের পূনর্জন্ম হবে, তা নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়। আগে হয়তো আওয়ামীলীগ ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছিলো, এবার দেবে বিএনপি। কারণ, নির্বাচন হলে তো তারাই ক্ষমতায় আসবে। তারাই বর্তমান সময়ে সংস্কারের তুমুল বিরোধী। তাদের সঙ্গে রয়েছে সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ- যারা ছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সমর্থক। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ হলেও, এই একটি স্বার্থের জায়গায় দু‘দলের দারুণ ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে।
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছিলেন। তখন একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, `স্বৈরাচারী হাসিনার পতন এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ‘
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছিলেন। তখন একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, `স্বৈরাচারী হাসিনার পতন এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ‘
সেই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কিভাবে হবে? রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করার পর যদি পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের কাছে তা নাই টেকে,তাহলে সংস্কার করে লাভ কি? সংসদে বসে সংশোধানী আনা হবে কিংবা পরবর্তীতে আইনীভাবে অবৈধও ঘোষণা করে দেয়া হতে পারে যে, ‘কোনো নির্বাচিত সরকার যেহেতু এই সংস্কারগুলো করেনি, সে কারণে এসব কিছুর সবই অবৈধ।’
এমন সম্ভাবনা সামনে রেখেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। যে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে সংস্কার প্রস্তাব পাশ এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন; কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।
সে কারণে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কারকে স্থায়ী ভিত্তি দেয়ার জন্য একটি `জাতীয় ঐকমত্য সনদ‘ (National Consensus Charter) স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছি। আশা করছি, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনগুলোর পেশকৃত সুপারিশমালা বা প্রস্তাবনাগুলো হয়তো এই জাতীয় ঐকমত্য সনদের মাধ্যমে এমন একটা স্থায়ী রূপ লাভ করবে, যেটাকে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বা কোনো আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারবে না। ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার ফিরে আসার পথও রূদ্ধ হয়ে যাবে। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং দূর্নীতি রোধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ। ক্ষমতায় যে‘ই আসুক, জনগণের কাছে জবাবদিহীতার মুখোমুখি হতে হবে তাদের, ফলে স্বৈরাচার হওয়ার কোনো সুযোগই তাদের সামনে থাকবে না।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনাগুলোকে সামনে রেখে স্বাক্ষরিত হবে এই ঐকমত্য সনদ। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে স্বাক্ষর করবে কারা, তারও একটা রূপরেখা প্রণয়ন করছি –
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে
* প্রতিটি দলের ১০জনের একটি প্রতিনিধি দল এই সনদে স্বাক্ষর করবে। যাতে কখনো, কোন কালে দলীয় প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন না ওঠে। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন বলতে না পারে, আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না এই সনদে ।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনাগুলোকে সামনে রেখে স্বাক্ষরিত হবে এই ঐকমত্য সনদ। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ।
* রাজনৈতিক দলে ১০জন প্রতিনিধির নেতৃত্বে থাকবেন সংশ্লিষ্ট দলের সাধারণ সম্পাদক। বাকি ৯জন দলীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে দলের ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, ভোটের মাধ্যমে। কিংবা প্রতিটি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে। প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টা অবশ্যই রেজুলেশনের মাধ্যমে হতে হবে এবং তার একটা কপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিতে হবে। এটা এ কারণে করতে হবে, যেন পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটি বা কোনো ব্যক্তি বলতে না পারে যে, ওই সনদে স্বাক্ষর করা ছিল অমুক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় বা তখন ওই `প্রতিনিধি দল‘ সম্পর্কে দল কিছু জানতো না।
* বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১০ জন সমন্বয়কও এই কমিশনে স্বাক্ষর করবেন। সমন্বয়কদের প্রতিনিধি দল নির্বাচনেও রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি অনুসরণ করতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারিরও স্বাক্ষর থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে এই দুই পক্ষ থেকে সনদ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ না থাকে ।
সরকারী বা সাংবিধানিক প্রতিনিধি
* প্রধান উপদেষ্টাছাড়াও এই সনদে স্বাক্ষর করবেন সকল উপদেষ্টাগণ।
* এই ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর করবেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ। দুদক, পিএসসি, এনবিআর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণও এই সনদে স্বাক্ষর করবেন। বিচারপতিরা এই সনদকে আইনী বৈধতা দান করবেন এবং ভবিষ্যতে যেন এই সনদের আইনী বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখিন না হয়, সে ব্যবস্থা নেবেন। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান বা প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করবেন, যেন ওসব পক্ষ থেকে কখনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ না থাকে।
* সনদে স্বাক্ষর করবেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, আনসার ব্যাটালিয়ন, পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাবের
প্রধানরা।
আর যারা স্বাক্ষর করবেন এই সনদে
* রাজনৈতিক দল, সরকারী ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এই জাতীয় ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর করবেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। যেমন, প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার (পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন, ম্যাগাজিন) সম্পাদক, প্রতিষ্ঠিত ও নিবন্ধিত পেশাজীবী এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উপাচার্যবৃন্দ, প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সভাপতি, বার কাউন্সিলের সভাপতি ও সেক্রেটারি, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, সকল ধর্মের প্রতিনিধি প্রমূখ।
সমাজের এসব প্রতিনিধির এ কারণে ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর প্রয়োজন, যেন ভবিষ্যতে কোন সময় কারও পক্ষ থেকে এই সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা না হয়। ভবিষ্যতে কেউ কখনো সংস্কার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এই জাতীয় ঐকমত্য সনদ সুরক্ষায় ভূমিকা পালন করবে । তখন এটাই হবে সংস্কারের স্থায়ী ভিত্তি।
লেখক: সাংবাদিক
mail: support.sohel.ocp@gmail.com
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ৬টি কমিশনের মধ্যে চারটি কমিশন এরই মধ্যে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে। সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ চারটি কমিশন তাদের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা পেশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
নির্বাচন, রাষ্ট্রক্ষমতা, সংবিধান, রাষ্ট্রের মূলনীতি, সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনসহ সংস্কার প্রস্তাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই তুলে আনা হয়েছে। দুই হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার বিদায়ের পর রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ে তোলের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবারই বলে থাকেন, ছাত্ররা আমাদের সামনে বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে।
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম থেকে শুরু করে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অন্য উপদেষ্টা ও ছাত্র নেতারা নানা সময়ে বলে আসছেন, `শুধুমাত্র একটি নির্বাচন দেয়ার জন্য দুই হাজারের বেশি প্রাণের বিনিময়ে এই গণ অভ্যুত্থান বা বিপ্লব হয়নি। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে পূনর্গঠনের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমরা এমন কিছু সংস্কার করতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে, ন্যায় বিচার পায়। দেশটা যেন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে না পারে। সর্বোপরি সমাজের প্রতিটি সেক্টরে যে বৈষম্য তৈরি হয়ে আছে, সেসব যেন দূর করা যায়, সে লক্ষ্যে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গুম, খুন, নির্যাতন, দূর্নীতি, মানি লন্ডারিংয়ের বিচার করতে হবে।‘
সমাজের প্রতিটি সেক্টরে যে বৈষম্য তৈরি হয়ে আছে, সেসব যেন দূর করা যায়, সে লক্ষ্যে জরুরি কিছু সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হাসিনার গুম, খুন, নির্যাতন, দূর্নীতি, মানি লন্ডারিংয়ের বিচার করতে হবে।
নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত চাপের মুখে সরকার দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিচ্ছেন। পাশাপাশি নির্বাচনের কার্যক্রমও শুরু করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র সংস্কার করা হবে চারধাপে। যার প্রথম ধাপে গঠন করা হয়েছে সংস্কার কমিশন। ৬টি কমিশন নানা প্রক্রিয়া শেষে তাদের সুপারিশমালা পেশ করেছে বা করবে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খোদ প্রধান উপদেষ্টা এর প্রধান। ৬ সংস্কার কমিশনের প্রধানরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
দ্বিতীয় ধাপের কাজ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংস্কার বিষয়ে আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বেই এই আলোচনা-পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় ধাপে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। চতুর্থ ধাপে হবে বাস্তবায়ন।
দেখলেই মনে হবে, কত সুন্দর পরিকল্পিত পন্থায়, সুচারুরূপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে, রাষ্ট্র এমন একটা চেহারা লাভ করবে, যে চেহারাটা দেখতে চায় সমস্ত দেশপ্রেমিক জনগন। সুপারিশকৃত এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে অবশ্যই বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, `জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে যে জনআকাঙ্ক্ষা ছিল, তা সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে।‘
চার সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা দেয়ার পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, `কমিশনগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটিসহ স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি খাতে সংস্কার আনতে পারবো। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের পর সরকার সেটি বাস্তবায়ন করবে।‘
খুব ভালো কথা। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে, দেশের খোলনলচে পাল্টে যাবে। দেশটা আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে ভারসাম্য তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে।
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হলে, দেশের খোলনলচে পাল্টে যাবে। দেশটা আর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয়ে উঠবে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে ভারসাম্য তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকবে।
কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস কী বলে? বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় চরিত্র ব্যাখ্যা করলে কী পাওয়া যাবে? এমনিতেই এই জাতি খুবই ভুলোমনা। এই জাতি ৫ মাস বয়সী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করবে, উপদেষ্টাদের গোষ্ঠি উদ্ধার করবে। অথচ, কোন অবস্থায়, কী পরিস্থিতিতে এ সরকারকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। শেখ হাসিনার অত্যাচার-নির্যাতনের কথা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে গণহত্যার কথা সাধারণ মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে। মানুষ জানে না শেখ হাসিনার লুটপাট, দূর্নীতি আর অর্থ পাচারের কারণে যে করুন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তারই জের টানতে হচ্ছে তাদেরকে; কিন্তু তারা সমালোচনা করা বা গালিটা দেয় বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা বা ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের।
ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার যাতে আর কখনো মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, রাষ্ট্র এবং সমাজের সকল স্তর থেকে যেন বৈষম্য দূর করা যায়- সে লক্ষ্যেই তো ৬টি সংস্কার কমিশন! ধরা যাক, এই কমিশনগুলো যে সংস্কার প্রস্তাব তুলে এনেছে, সেগুলো আলোচনা-পর্যালোচনার পর পাশ হলো, বাস্তবায়ন পুরো হোক কিংবা আংশিক, করে দিয়ে গেলো এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এরপর কী হবে?
এরই মধ্যে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসছে, `সংস্কার করার অধিকার বর্তমান সরকার বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকারীদের নেই। সংস্কার করবে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার। ‘শুধু তাই নয়, বিএনপিসহ অনেকেই সংস্কারের নানা টপিক নিয়ে তুমুল বিরোধীতা করছে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, `অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে সংস্কার করা জনপ্রতিনিধিদের কাজ। ছাত্র কিংবা উপদেষ্টাদের সংস্কারের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার কোনো অধিকার নাই। তারা মনে করে ইলেকশন দিলেই তো বিএনপি চলে আসবে। জনগন যদি বিএনপিকে ভোট দেয়, এটা তো আমাদের দোষ না। ‘
শুধু মেজর (অব.) হাফিজ যে মত দিয়েছেন, তা পুরো বিএনপিএরই মত হিসেবে ধরে নেয়া যায়। কারণ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভীর সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোই সেটা প্রমাণ করে। মির্জা ফখরুল সাহেব সংবিধান সংশোধন করতে রাজি নন। রাষ্ট্রপতিকে সরাতে রাজি নন। সংস্কারের অধিকাংশেরই বিরোধীতা করছেন তিনি। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন।
মির্জা ফখরুল সাহেব সংবিধান সংশোধন করতে রাজি নন। রাষ্ট্রপতিকে সরাতে রাজি নন। সংস্কারের অধিকাংশেরই বিরোধীতা করছেন তিনি। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এসবের অর্থ হলো, নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ড. ইউনূস সরকার বিদায় নিলে, তখনকার রাজনৈতিক সরকার কর্তৃক সংসদে বসে মেজরিটি মেন্ডেটের ভিত্তিতে এইসব সংস্কার আমূল বদলে দেয়া হবে! নিজেদের মত করে আবার সব কিছু লেখা হবে, তৈরি করা হবে!
১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর সংবিধান প্রণয়নের পর থেকে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে সংবিধানে। এই ১৭টি সংশোধনীর কয়টি প্রকৃতই রাষ্ট্র এবং জনগনের স্বার্থে করা হয়েছে? যে সরকার সংবিধান প্রণয়ন করেছিলো, নিজেদের স্বার্থে তারাই তাদের মেয়াদকালে ৪বার সংশোধনী এনেছিল। সর্বশেষ তো সংবিধান সংশোধন (চতুর্থ) করে তারা গণতন্ত্রই হরণ করেছিলো বাকশাল কায়েম করে।
প্রতিটা সংশোধনীরই মুখ্য এবং সুক্ষ উদ্দেশ্য ছিল তখনকার সরকারের ক্ষমতা স্থায়ী এবং নিরঙ্কুশ করার বন্দোবস্ত করা। সংসদে মেজরিটি পেলেই সংবিধান সংশোধনী বিল আনতে হবে- এটা যেন একটা নিয়মে পরিণত করেছিল বিগত সরকারগুলো। ভবিষ্যতেও যে হবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? তেমনটা যে ঘটবে, বড় বড় রাজতৈনিক দলগুলোর আচার-আচরণেই তো বোঝা যাচ্ছে।
সুতরাং, আবু সাঈদ-মুগ্ধ থেকে শুরু করে প্রায় দুই হাজার মানুষের আত্মদান কী তাহলে বৃথা হয়ে যাবে? সমাজ থেকে বৈষম্য দূর হবে না? ক্ষমতার ভারসাম্য আনার জন্য যে চেষ্টা বর্তমান সরকার ও আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা করে যাচ্ছে, সেই চেষ্টা কী বৃথা হযে যাবে? ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের যে জনআকাঙ্খা তৈরি হয়েছে, তা কী বাস্তবায়ন হবে না? পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বহাল থাকলে যে ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচারের পূনর্জন্ম হবে, তা নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়। আগে হয়তো আওয়ামীলীগ ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের জন্ম দিয়েছিলো, এবার দেবে বিএনপি। কারণ, নির্বাচন হলে তো তারাই ক্ষমতায় আসবে। তারাই বর্তমান সময়ে সংস্কারের তুমুল বিরোধী। তাদের সঙ্গে রয়েছে সমাজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ- যারা ছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সমর্থক। রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ হলেও, এই একটি স্বার্থের জায়গায় দু‘দলের দারুণ ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে।
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছিলেন। তখন একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, `স্বৈরাচারী হাসিনার পতন এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ‘
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে যখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছিলেন। তখন একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, `স্বৈরাচারী হাসিনার পতন এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। ‘
সেই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কিভাবে হবে? রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কার করার পর যদি পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের কাছে তা নাই টেকে,তাহলে সংস্কার করে লাভ কি? সংসদে বসে সংশোধানী আনা হবে কিংবা পরবর্তীতে আইনীভাবে অবৈধও ঘোষণা করে দেয়া হতে পারে যে, ‘কোনো নির্বাচিত সরকার যেহেতু এই সংস্কারগুলো করেনি, সে কারণে এসব কিছুর সবই অবৈধ।’
এমন সম্ভাবনা সামনে রেখেই হয়তো প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। যে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে সংস্কার প্রস্তাব পাশ এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন; কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।
সে কারণে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কারকে স্থায়ী ভিত্তি দেয়ার জন্য একটি `জাতীয় ঐকমত্য সনদ‘ (National Consensus Charter) স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছি। আশা করছি, রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনগুলোর পেশকৃত সুপারিশমালা বা প্রস্তাবনাগুলো হয়তো এই জাতীয় ঐকমত্য সনদের মাধ্যমে এমন একটা স্থায়ী রূপ লাভ করবে, যেটাকে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বা কোনো আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করতে পারবে না। ফ্যাসিবাদ এবং স্বৈরাচার ফিরে আসার পথও রূদ্ধ হয়ে যাবে। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং দূর্নীতি রোধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এ সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ। ক্ষমতায় যে‘ই আসুক, জনগণের কাছে জবাবদিহীতার মুখোমুখি হতে হবে তাদের, ফলে স্বৈরাচার হওয়ার কোনো সুযোগই তাদের সামনে থাকবে না।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনাগুলোকে সামনে রেখে স্বাক্ষরিত হবে এই ঐকমত্য সনদ। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে স্বাক্ষর করবে কারা, তারও একটা রূপরেখা প্রণয়ন করছি –
রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে
* প্রতিটি দলের ১০জনের একটি প্রতিনিধি দল এই সনদে স্বাক্ষর করবে। যাতে কখনো, কোন কালে দলীয় প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে প্রশ্ন না ওঠে। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন বলতে না পারে, আমাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না এই সনদে ।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনাগুলোকে সামনে রেখে স্বাক্ষরিত হবে এই ঐকমত্য সনদ। রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়া, বৈষম্যের নিরসণ, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এই সনদ হবে আগামীর বাংলাদেশের রূপরেখা। যেটাকে মেনে চলতে বাধ্য হবে সব রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রে বিদ্যমান প্রতিটি পক্ষ।
* রাজনৈতিক দলে ১০জন প্রতিনিধির নেতৃত্বে থাকবেন সংশ্লিষ্ট দলের সাধারণ সম্পাদক। বাকি ৯জন দলীয় প্রতিনিধি নির্বাচন করতে হবে দলের ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, ভোটের মাধ্যমে। কিংবা প্রতিটি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামে আলোচনার ভিত্তিতে। প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টা অবশ্যই রেজুলেশনের মাধ্যমে হতে হবে এবং তার একটা কপি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দিতে হবে। এটা এ কারণে করতে হবে, যেন পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটি বা কোনো ব্যক্তি বলতে না পারে যে, ওই সনদে স্বাক্ষর করা ছিল অমুক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয় বা তখন ওই `প্রতিনিধি দল‘ সম্পর্কে দল কিছু জানতো না।
* বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১০ জন সমন্বয়কও এই কমিশনে স্বাক্ষর করবেন। সমন্বয়কদের প্রতিনিধি দল নির্বাচনেও রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি অনুসরণ করতে হবে। একই সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারিরও স্বাক্ষর থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে এই দুই পক্ষ থেকে সনদ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ না থাকে ।
সরকারী বা সাংবিধানিক প্রতিনিধি
* প্রধান উপদেষ্টাছাড়াও এই সনদে স্বাক্ষর করবেন সকল উপদেষ্টাগণ।
* এই ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর করবেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ। দুদক, পিএসসি, এনবিআর, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণও এই সনদে স্বাক্ষর করবেন। বিচারপতিরা এই সনদকে আইনী বৈধতা দান করবেন এবং ভবিষ্যতে যেন এই সনদের আইনী বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখিন না হয়, সে ব্যবস্থা নেবেন। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান বা প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করবেন, যেন ওসব পক্ষ থেকে কখনো প্রশ্ন তোলার অবকাশ না থাকে।
* সনদে স্বাক্ষর করবেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, আনসার ব্যাটালিয়ন, পুলিশ, বিজিবি এবং র্যাবের
প্রধানরা।
আর যারা স্বাক্ষর করবেন এই সনদে
* রাজনৈতিক দল, সরকারী ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এই জাতীয় ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর করবেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। যেমন, প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ার (পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন, ম্যাগাজিন) সম্পাদক, প্রতিষ্ঠিত ও নিবন্ধিত পেশাজীবী এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের উপাচার্যবৃন্দ, প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সভাপতি, বার কাউন্সিলের সভাপতি ও সেক্রেটারি, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, সকল ধর্মের প্রতিনিধি প্রমূখ।
সমাজের এসব প্রতিনিধির এ কারণে ঐকমত্য সনদে স্বাক্ষর প্রয়োজন, যেন ভবিষ্যতে কোন সময় কারও পক্ষ থেকে এই সনদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা না হয়। ভবিষ্যতে কেউ কখনো সংস্কার বিষয়ে প্রশ্ন তুললে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এই জাতীয় ঐকমত্য সনদ সুরক্ষায় ভূমিকা পালন করবে । তখন এটাই হবে সংস্কারের স্থায়ী ভিত্তি।
লেখক: সাংবাদিক
mail: support.sohel.ocp@gmail.com