ঢাকা: সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

Follow :

31°C
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা ছাত্ররা, অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা কে?

সোহেল ইমাম ১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:৫০ ৫ মিনিটে পড়ুন

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনদিন সরকারহীন ছিল বাংলাদেশ। ৮ আগস্ট শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। প্রাথমিকভাবে ১৬জন উপদেষ্টা শপথ নেন। এরপর কয়েক দফায় উপদেষ্টা পরিষদের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪-এ।

দায়িত্ব গ্রহণের ১৭দিন পর, ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। সেই ভাষণে তার সরকারের কার্যক্রম, কী লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে তারা দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, সামনে কী করতে চান, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খাকে কিভাবে বাস্তবায়ন করতে চান, কিভাবে নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান- সে সব বিষয় তার ভাষণে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

ওই ভাষণ দানকালেই ড. ইউনূস নির্বাচন প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তাদেরকে কারা দায়িত্বে এনেছে, কারা নিয়োগ করেছে সে বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, `কখন নির্বাচন হবে’ এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, `এটা আমাদের সিদ্ধান্ত না। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে কখন আপনারা আমাদের ছেড়ে দিবেন। আমরা ছাত্রদের আহবানে এসেছি, ছাত্ররাই আমাদের প্রাথমিক নিয়োগ কর্তা।‘

অর্থ্যাৎ, প্রধান উপদেষ্টা তার প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তারা দায়িত্ব নিয়েছেন ছাত্রদের আহ্বানে। উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা ছাত্ররাই। নিঃসন্দেহে এই উপদেষ্টা পরিষদ – ৮ আগস্ট শপথের জন্য নির্ধারিত ১৬ জনের কথাই বলা হচ্ছে। যাদের মধ্যে ১৩জন প্রথমদিন শপথ নেন। বাকি তিনজন পরে শপথ নেন।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের ক্ষণে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই ভাষণেই তিনি জানিয়েছেন, আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধির সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন। দ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা তার প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তারা দায়িত্ব নিয়েছেন ছাত্রদের আহ্বানে। উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা ছাত্ররাই। নিঃসন্দেহে এই উপদেষ্টা পরিষদ – ৮ আগস্ট শপথের জন্য নির্ধারিত ১৬ জনের কথাই বলা হচ্ছে।

একইদিন রাতে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, তারা পরের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবেন এবং তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোন সরকার তারা সমর্থন করবেন না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার ১০০দিন পার হওয়ার পরও তখনকার সময়ে সরকার গঠন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে নানা তত্ত্ব শোনা যায়। শোনা যায়- বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদকে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব উঠে আসে; কিন্তু ছাত্রনেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তারা নিজেরাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব তুলে ধরেন।

বাকি ১৩জন উপদেষ্টা কিভাবে নির্ধারিত হলো, কারা কার নাম প্রস্তাব করেছিলেন? সে সম্পর্কে ভেতরের ইতিহাস প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে খুব একটা জানে না। আবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেননি।

নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে এটাই শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেই সরকার গঠন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া প্রথমদিন শপথ নেয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং আন্দোলনে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলও ছিলেন। এ তিনজন উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন, অনেকটাই জানা কথা ছিল।

বাকি ১৩জন উপদেষ্টা কিভাবে নির্ধারিত হলো, কারা কার নাম প্রস্তাব করেছিলেন? সে সম্পর্কে ভেতরের ইতিহাস প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে খুব একটা জানে না। আবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেননি। এটা তিনি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, ৮ আগস্ট বিমানবন্দরে নামার পর ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ও কথা হয়। এরপর তিনি চলে আসেন বঙ্গভবনে এবং শপথ নেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।’

উপদেষ্টাদেরও যে তিনি চিনতেন না, সেটাও জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।’

প্রথম যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো, তাদেরকে কিভাবে নির্বাচন বা বাছাই করা হলো? ছাত্ররা কী তাদের সবাইকে চিনতেন? ছাত্ররাই যদি এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে থাকবেন, তাহলে কয়েকদিনের মাথায় কেন অন্যতম উপদেষ্টা, তখনকার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর পরিবর্তন করতে হলো?

বোঝা গেলো, যিনি সরকার চালাবেন তিনিই জানতেন না, কাদের নিয়ে তাকে চলতে হবে! ড. ইউনূস দেশে আসার আগেই নির্ধারণ হয়েছিলো উপদেষ্টা পরিষদ। যাদের কারো কারো নামে ঢালাও অভিযোগ শোনা যেতে লাগলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাদের কেউ কেউ ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সঙ্গে ছিল, কেউ কেউ ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলো, কেউ কেউ আওয়ামীলীগ সরকারকে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আনতে ভূমিকা রেখেছিলো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, তাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা ছাত্ররা। তাহলে এখানে প্রশ্নযুক্ত উপদেষ্টা পরিষদ তৈরি করলো কারা? ছাত্ররাই কী এ ভূমিকা পালন করেছিলেন? নাহিদ ইসলাম যে ৫ আগস্ট রাতে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোন সরকারকে তারা সমর্থন করবেন না।! এরই ঘোষণার ওপর তারা নিজেরা কতটা অটল থাকতে পেরেছিলেন?

তবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে যে খুবই নগন্য ভূমিকা ছিল, অনেকাংশে তাদেরকে যে উপেক্ষা করা হচ্ছিলো, তা উঠে এসেছে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদের একটি টিভি সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি ৫ আগস্টের সরকার গঠনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরেন।

আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘একটা বিষয় এখানে আমার মনে হয় ক্লিয়ার করা উচিৎ, বাংলাদেশে ৫ আগস্ট গনঅভ্যুত্থানে কী হয়েছিলো। ৫ আগস্ট যখন আমরা চাংখারপুলে গুলি খাচ্ছিলাম, বাসা থেকে আগাতে পারছিলাম না, আশপাশে লাশ পড়তেছিলো, ঢাকা মেডিক্যালে যখন লাশের সারি, তখন সেনা নিবাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সকল নেতারা গিয়ে সেখানে বৈঠক করেছে। অথচ আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম, তারা তখনও গুলির মুখে। তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছিলো। এমনকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সেই মিটিংয়ে এবং সেখান থেকে বের হয়ে বঙ্গভবনে যে মিটিংটা হয়েছে, তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছাত্র প্রতিনিধি বানিয়ে, যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ ছিল না।’

‘এভাবেই সেখানে গভমেন্ট ফরমেশনের একটা চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। তাদের সম্পর্কে এখানে আর বেশিকিছু বলতে চাচ্ছি না। আজকে বলা হয়ে থাকে যে, পুরো গভরমেন্টটাই আমাদের। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেদিন আমাদেরকেই মাইনাস করেই গভরমেন্ট ফর্ম (গঠন) হতে যাচ্ছিলো। সেখান থেকে আমরা বার্গেইনিং করে, আমরা আমাদের স্টেক হিসেবে, গণঅভ্যুত্থানের স্টেক হিসেবে বললে- আমাদের সেখানে তিনজন মানুষকে দিয়েছি। অনেক বার্গেইনিংয়ের পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদদের দিতে পেরেছি। সেখানে আমরা আমাদের আরও কয়েকজনকে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বার্গেইনিংয়ে বা আরও যারা স্টেকহোল্ডার ছিল, তাদের বার্গেইনিংয়ে আমাদের পক্ষে অন্তত যারা সামনের সারি থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো (তাদেরকে দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু) তারা যদি আজকে থাকতো (তাহলে সরকার আরো অনেক ভালো চলতো)। নাহিদ ইসলামের মন্ত্রণালয়, আসিফ মাহমুদের মন্ত্রণালয়- তাদের কাজের গতি আর অন্যদের মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি এক হচ্ছে না। এটা আপনাদের কাছ থেকে শুনতেছি। ’

‘কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে সেদিন রাজনৈতিক দলগুলো ধারণ না করে, প্রথম হচ্ছে সেদিন আমাদের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে, প্রতারণা করেছে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্মের সঙ্গে প্রতারণা করেছে যেদিন বঙ্গভবনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাইরের তিনজন ব্যক্তিকে সমন্বয়ক সাজিয়ে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা কী চেনে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি কারা?’

‘আজকে আমাদের সারাদিন শুনতে হচ্ছে, গভরমেন্টের ফরমেশন করেছি। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই গভরমেন্টে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক বার্গেইনিং করে আমরা এখানে এনেছি, কারণ বাংলাদেশের জন্যে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যে। পাশাপাশি বার্গেইনিং করে আমরা সেখানে আমাদের দু’জন উপদেষ্টা রেখেছি। পরবর্তীতে আমাদের মাহফুজ আবদুল্লাহ ভাইকে এড করা হয়েছে। ’

‘এরপর আজ পর্যন্ত গভরমেন্টের প্রতিটা উপদেষ্টা, একজন উপদেষ্টাও যদি আমাদেরকে রিচ করতো যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিড দেয়া পরিচিত ফেইস আছে ১০-১২ টা। অন্তত এই ১০-১২ জন – আমি বলছি না যে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, অন্তত এই ১০-১২জনের সাথে একদিনের জন্যও মিটিং করার সময় হয়নি এই উপদেষ্টা পরিষদের। ’

‘ওনাদের দায়গুলো কেন আমার নেবো এখানে বসে। ওনারা যদি না পারে, তাহলে ওনারা সরে যাবে। স্পষ্টত আমরা যেটা বলতে চাচ্ছি, যে রক্তের ওপর গণ অভ্যুত্থান হয়েছে, আমরা যারা আহত, আমরা যারা রাজপথে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছি, আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাচ্ছি, ওনার মন্ত্রণালয়কে কেমন দেখতে চাচ্ছি, তাদের উচিৎ ছিল আমাদেরকে ডেকে সেটা শোনা। ওনারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, একটা কোটায় পেয়ে গেছেন, এসে গেছেন, এভাবেই চলতেছে।’

প্রথম যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো, তাদেরকে কিভাবে নির্বাচন বা বাছাই করা হলো? ছাত্ররা কী তাদের সবাইকে চিনতেন? ছাত্ররাই যদি এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে থাকবেন, তাহলে কয়েকদিনের মাথায় কেন অন্যতম উপদেষ্টা, তখনকার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর পরিবর্তন করতে হলো? কেন তারা ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের জন্য রাজনৈতিক স্পেস খুঁজে দিতে তৎপর হয়েছিলেন? ছাত্র-জনতা কী এ জন্যই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো? ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন কিভাবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ বলতে বলতে মুখের ফেনা বের করে ফেলেন! আসিফ নজরুলরা কিভাবে মাথার পেছনে ফ্যাসিবাদের আইকন শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানিয়ে রাখতে পারে?

সর্বশেষ নিয়োগ করা হলো আর তিন উপদেষ্টা। এদের মধ্যে একজন ছাত্রপ্রতিনিধি (মাহফুজ আলম)। বাকি দু’জনকে নিয়ে তুমুল আপত্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এনজিও প্রতিনিধির আধিক্য রাখা হয়েছে এই সরকারে। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এনজিওগ্রাম’ সরকার হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী দেশ পরিচালনার অনেক যোগ্য ব্যক্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে তথাকথিত এনজিওগ্রাম সরকার গঠন হলো? তাদের নিয়োগকর্তাও কী ছাত্ররা? এই উপদেষ্টা পরিষদ বাছাই করলো কে?

এরপর সরকারে আনা হলো আরও ৪জন উপদেষ্টা। সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিডিআরের সাবেক ডিজি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এই চার উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা কে? ছাত্ররা? কিভাবে ছাত্ররা নিয়োগকর্তা হলেন? এদের মধ্যে কোনো কোনো উপদেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফ্যাসিবাদীদের পূনর্বাসনে তাদের কাউকে কাউকে সচেষ্ট হতেও দেখা গেছে। উপদেষ্টা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে পাশ কাটানো কিংবা এ দু‘জনকে কোনঠাসা করে রাখার কথাও শোনা যায়।

সর্বশেষ নিয়োগ করা হলো আর তিন উপদেষ্টা। এদের মধ্যে একজন ছাত্রপ্রতিনিধি (মাহফুজ আলম)। বাকি দু’জনকে নিয়ে তুমুল আপত্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফারুকী ছিলেন এক সময় শাহবাগী। সেখ বশির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যায় মামলা রয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও তারা কিভাবে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেলেন? তা নিয়ে বিস্মিত খোদ ছাত্র সমাজই।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম তো সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, ফারুকীরা কীভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে? আন্দোলনের সময়ে নীরব থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে চলা লোকদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চান না তারা।

ফারুকী ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য তোষামোদি করেছে উল্লেখ করে সারজিস বলেন, ‘আমরা দেখেছি ফারুকীকে বিগত এই ৩৬ জুলাই কোন সময়ে সরাসরি সরকারের বিপক্ষে গিয়ে এই ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে কখনও অবস্থান নেননি। তিনি তার পুরো সময়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য যেখানে তার মতো করে তুষামদি করা দরকার সেভাবে করেছে।’

‘হতে পারে একটা লাইন লিখে, হতে পারে একটা ছবি তুলে। সবাই এক কাতারে ভাই ভাই সহমত ভাই বলে তোষামোদি করবে না। কেউ একটা লাইন লিখে কেউ একটা শব্দ বলে তোষামোদি করে। এই ফারুকীরা কীভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে? আমাদের জায়গা থেকে আমরা সেদিন স্পষ্ট করে বিরোধিতা জানিয়েছি। আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলি, এরকম নীরব থাকা কঠিন সময়ে নিজের গা বাঁচিয়ে চলা লোকদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চাই না। তারা কোনোদিন আন্দোলনের স্পিরিটকে ধারণ করতে পারে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ফারুকী এবং সেখ বশির উদ্দিনের অপসারণ চেয়ে আন্দোলনেরও ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং, এখানে স্পষ্ট এই উপদেষ্টাদেরও ছাত্ররা নিয়োগ দেয়নি। এমকি বলা যায়, সরকারে ভেতরে থেকেও উপদেষ্টা নিয়োগে নিজেদের ভূমিকা রাখারও সুযোগ পাননি তারা।

ফারুকী কিংবা বশির- এদের নিয়োগের পরপরই প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের নিয়োগ কর্তা কে? তাদের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হওয়ার পরই সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবারই প্রশ্ন, এমন ধরনের মানুষ কিভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে?

সারজিস আলমের মতোই দেশের মুক্তিকামী জনতার একটাই বক্তব্য, যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্পিরিটই ধারণ করেন না, তারা কিভাবে সরকার পরিচালনায় উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হন? এ ধরনের লোকদের নিয়োগে কোন অপশক্তি সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে, তাদের চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। না হয়, বিপ্লব যেটুকু বেহাত হয়েছে, সেটা শতভাগ বেহাত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের পরিস্থিতি আপাতত যেন সেদিকেই যাচ্ছে। কড়া নজর রাখা খুব জরুরি।

shomoerkotha@gmail.com
facebook.com/shomoyerkotha

জনপ্রিয় বিষয়

জনপ্রিয় সংবাদ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা ছাত্ররা, অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা কে?

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনদিন সরকারহীন ছিল বাংলাদেশ। ৮ আগস্ট শপথ নেয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। প্রাথমিকভাবে ১৬জন উপদেষ্টা শপথ নেন। এরপর কয়েক দফায় উপদেষ্টা পরিষদের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪-এ।

দায়িত্ব গ্রহণের ১৭দিন পর, ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। সেই ভাষণে তার সরকারের কার্যক্রম, কী লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে তারা দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, সামনে কী করতে চান, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খাকে কিভাবে বাস্তবায়ন করতে চান, কিভাবে নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান- সে সব বিষয় তার ভাষণে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

ওই ভাষণ দানকালেই ড. ইউনূস নির্বাচন প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই তাদেরকে কারা দায়িত্বে এনেছে, কারা নিয়োগ করেছে সে বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, `কখন নির্বাচন হবে’ এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, `এটা আমাদের সিদ্ধান্ত না। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে কখন আপনারা আমাদের ছেড়ে দিবেন। আমরা ছাত্রদের আহবানে এসেছি, ছাত্ররাই আমাদের প্রাথমিক নিয়োগ কর্তা।‘

অর্থ্যাৎ, প্রধান উপদেষ্টা তার প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তারা দায়িত্ব নিয়েছেন ছাত্রদের আহ্বানে। উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা ছাত্ররাই। নিঃসন্দেহে এই উপদেষ্টা পরিষদ – ৮ আগস্ট শপথের জন্য নির্ধারিত ১৬ জনের কথাই বলা হচ্ছে। যাদের মধ্যে ১৩জন প্রথমদিন শপথ নেন। বাকি তিনজন পরে শপথ নেন।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের ক্ষণে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই ভাষণেই তিনি জানিয়েছেন, আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধির সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন। দ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টা তার প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন, তারা দায়িত্ব নিয়েছেন ছাত্রদের আহ্বানে। উপদেষ্টাদের নিয়োগকর্তা ছাত্ররাই। নিঃসন্দেহে এই উপদেষ্টা পরিষদ – ৮ আগস্ট শপথের জন্য নির্ধারিত ১৬ জনের কথাই বলা হচ্ছে।

একইদিন রাতে সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, তারা পরের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করবেন এবং তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোন সরকার তারা সমর্থন করবেন না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার ১০০দিন পার হওয়ার পরও তখনকার সময়ে সরকার গঠন সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে নানা তত্ত্ব শোনা যায়। শোনা যায়- বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদকে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব উঠে আসে; কিন্তু ছাত্রনেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তারা নিজেরাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব তুলে ধরেন।

বাকি ১৩জন উপদেষ্টা কিভাবে নির্ধারিত হলো, কারা কার নাম প্রস্তাব করেছিলেন? সে সম্পর্কে ভেতরের ইতিহাস প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে খুব একটা জানে না। আবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেননি।

নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে এটাই শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো, নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেই সরকার গঠন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া প্রথমদিন শপথ নেয়ার জন্য নির্দিষ্ট করা ১৬ উপদেষ্টার মধ্যে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং আন্দোলনে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলও ছিলেন। এ তিনজন উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন, অনেকটাই জানা কথা ছিল।

বাকি ১৩জন উপদেষ্টা কিভাবে নির্ধারিত হলো, কারা কার নাম প্রস্তাব করেছিলেন? সে সম্পর্কে ভেতরের ইতিহাস প্রকাশ করা হয়নি। সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে খুব একটা জানে না। আবার প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেননি। এটা তিনি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেছেন।

তিনি জানিয়েছেন, ৮ আগস্ট বিমানবন্দরে নামার পর ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় ও কথা হয়। এরপর তিনি চলে আসেন বঙ্গভবনে এবং শপথ নেন। ড. ইউনূস বলেন, ‘এদের কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।’

উপদেষ্টাদেরও যে তিনি চিনতেন না, সেটাও জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।’

প্রথম যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো, তাদেরকে কিভাবে নির্বাচন বা বাছাই করা হলো? ছাত্ররা কী তাদের সবাইকে চিনতেন? ছাত্ররাই যদি এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে থাকবেন, তাহলে কয়েকদিনের মাথায় কেন অন্যতম উপদেষ্টা, তখনকার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর পরিবর্তন করতে হলো?

বোঝা গেলো, যিনি সরকার চালাবেন তিনিই জানতেন না, কাদের নিয়ে তাকে চলতে হবে! ড. ইউনূস দেশে আসার আগেই নির্ধারণ হয়েছিলো উপদেষ্টা পরিষদ। যাদের কারো কারো নামে ঢালাও অভিযোগ শোনা যেতে লাগলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাদের কেউ কেউ ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সঙ্গে ছিল, কেউ কেউ ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলো, কেউ কেউ আওয়ামীলীগ সরকারকে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আনতে ভূমিকা রেখেছিলো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, তাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা ছাত্ররা। তাহলে এখানে প্রশ্নযুক্ত উপদেষ্টা পরিষদ তৈরি করলো কারা? ছাত্ররাই কী এ ভূমিকা পালন করেছিলেন? নাহিদ ইসলাম যে ৫ আগস্ট রাতে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত ছাড়া কোন সরকারকে তারা সমর্থন করবেন না।! এরই ঘোষণার ওপর তারা নিজেরা কতটা অটল থাকতে পেরেছিলেন?

তবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠনে যে খুবই নগন্য ভূমিকা ছিল, অনেকাংশে তাদেরকে যে উপেক্ষা করা হচ্ছিলো, তা উঠে এসেছে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদের একটি টিভি সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি ৫ আগস্টের সরকার গঠনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরেন।

আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘একটা বিষয় এখানে আমার মনে হয় ক্লিয়ার করা উচিৎ, বাংলাদেশে ৫ আগস্ট গনঅভ্যুত্থানে কী হয়েছিলো। ৫ আগস্ট যখন আমরা চাংখারপুলে গুলি খাচ্ছিলাম, বাসা থেকে আগাতে পারছিলাম না, আশপাশে লাশ পড়তেছিলো, ঢাকা মেডিক্যালে যখন লাশের সারি, তখন সেনা নিবাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সকল নেতারা গিয়ে সেখানে বৈঠক করেছে। অথচ আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম, তারা তখনও গুলির মুখে। তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছিলো। এমনকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে, সেই মিটিংয়ে এবং সেখান থেকে বের হয়ে বঙ্গভবনে যে মিটিংটা হয়েছে, তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছাত্র প্রতিনিধি বানিয়ে, যারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ ছিল না।’

‘এভাবেই সেখানে গভমেন্ট ফরমেশনের একটা চেষ্টা চালানো হয়েছিলো। তাদের সম্পর্কে এখানে আর বেশিকিছু বলতে চাচ্ছি না। আজকে বলা হয়ে থাকে যে, পুরো গভরমেন্টটাই আমাদের। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সেদিন আমাদেরকেই মাইনাস করেই গভরমেন্ট ফর্ম (গঠন) হতে যাচ্ছিলো। সেখান থেকে আমরা বার্গেইনিং করে, আমরা আমাদের স্টেক হিসেবে, গণঅভ্যুত্থানের স্টেক হিসেবে বললে- আমাদের সেখানে তিনজন মানুষকে দিয়েছি। অনেক বার্গেইনিংয়ের পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদদের দিতে পেরেছি। সেখানে আমরা আমাদের আরও কয়েকজনকে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বার্গেইনিংয়ে বা আরও যারা স্টেকহোল্ডার ছিল, তাদের বার্গেইনিংয়ে আমাদের পক্ষে অন্তত যারা সামনের সারি থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো (তাদেরকে দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু) তারা যদি আজকে থাকতো (তাহলে সরকার আরো অনেক ভালো চলতো)। নাহিদ ইসলামের মন্ত্রণালয়, আসিফ মাহমুদের মন্ত্রণালয়- তাদের কাজের গতি আর অন্যদের মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি এক হচ্ছে না। এটা আপনাদের কাছ থেকে শুনতেছি। ’

‘কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের শক্তিকে সেদিন রাজনৈতিক দলগুলো ধারণ না করে, প্রথম হচ্ছে সেদিন আমাদের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে, প্রতারণা করেছে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্মের সঙ্গে প্রতারণা করেছে যেদিন বঙ্গভবনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বাইরের তিনজন ব্যক্তিকে সমন্বয়ক সাজিয়ে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা কী চেনে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি কারা?’

‘আজকে আমাদের সারাদিন শুনতে হচ্ছে, গভরমেন্টের ফরমেশন করেছি। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই গভরমেন্টে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনেক বার্গেইনিং করে আমরা এখানে এনেছি, কারণ বাংলাদেশের জন্যে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যে। পাশাপাশি বার্গেইনিং করে আমরা সেখানে আমাদের দু’জন উপদেষ্টা রেখেছি। পরবর্তীতে আমাদের মাহফুজ আবদুল্লাহ ভাইকে এড করা হয়েছে। ’

‘এরপর আজ পর্যন্ত গভরমেন্টের প্রতিটা উপদেষ্টা, একজন উপদেষ্টাও যদি আমাদেরকে রিচ করতো যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিড দেয়া পরিচিত ফেইস আছে ১০-১২ টা। অন্তত এই ১০-১২ জন – আমি বলছি না যে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ করতে হবে, অন্তত এই ১০-১২জনের সাথে একদিনের জন্যও মিটিং করার সময় হয়নি এই উপদেষ্টা পরিষদের। ’

‘ওনাদের দায়গুলো কেন আমার নেবো এখানে বসে। ওনারা যদি না পারে, তাহলে ওনারা সরে যাবে। স্পষ্টত আমরা যেটা বলতে চাচ্ছি, যে রক্তের ওপর গণ অভ্যুত্থান হয়েছে, আমরা যারা আহত, আমরা যারা রাজপথে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছি, আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাচ্ছি, ওনার মন্ত্রণালয়কে কেমন দেখতে চাচ্ছি, তাদের উচিৎ ছিল আমাদেরকে ডেকে সেটা শোনা। ওনারা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন, একটা কোটায় পেয়ে গেছেন, এসে গেছেন, এভাবেই চলতেছে।’

প্রথম যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো, তাদেরকে কিভাবে নির্বাচন বা বাছাই করা হলো? ছাত্ররা কী তাদের সবাইকে চিনতেন? ছাত্ররাই যদি এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে থাকবেন, তাহলে কয়েকদিনের মাথায় কেন অন্যতম উপদেষ্টা, তখনকার সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর পরিবর্তন করতে হলো? কেন তারা ফ্যাসিবাদী আওয়ামীলীগের জন্য রাজনৈতিক স্পেস খুঁজে দিতে তৎপর হয়েছিলেন? ছাত্র-জনতা কী এ জন্যই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো? ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন কিভাবে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বঙ্গবন্ধু’ বলতে বলতে মুখের ফেনা বের করে ফেলেন! আসিফ নজরুলরা কিভাবে মাথার পেছনে ফ্যাসিবাদের আইকন শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানিয়ে রাখতে পারে?

সর্বশেষ নিয়োগ করা হলো আর তিন উপদেষ্টা। এদের মধ্যে একজন ছাত্রপ্রতিনিধি (মাহফুজ আলম)। বাকি দু’জনকে নিয়ে তুমুল আপত্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এনজিও প্রতিনিধির আধিক্য রাখা হয়েছে এই সরকারে। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এনজিওগ্রাম’ সরকার হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী দেশ পরিচালনার অনেক যোগ্য ব্যক্তিত্বকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে তথাকথিত এনজিওগ্রাম সরকার গঠন হলো? তাদের নিয়োগকর্তাও কী ছাত্ররা? এই উপদেষ্টা পরিষদ বাছাই করলো কে?

এরপর সরকারে আনা হলো আরও ৪জন উপদেষ্টা। সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিডিআরের সাবেক ডিজি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এই চার উপদেষ্টার নিয়োগকর্তা কে? ছাত্ররা? কিভাবে ছাত্ররা নিয়োগকর্তা হলেন? এদের মধ্যে কোনো কোনো উপদেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফ্যাসিবাদীদের পূনর্বাসনে তাদের কাউকে কাউকে সচেষ্ট হতেও দেখা গেছে। উপদেষ্টা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে পাশ কাটানো কিংবা এ দু‘জনকে কোনঠাসা করে রাখার কথাও শোনা যায়।

সর্বশেষ নিয়োগ করা হলো আর তিন উপদেষ্টা। এদের মধ্যে একজন ছাত্রপ্রতিনিধি (মাহফুজ আলম)। বাকি দু’জনকে নিয়ে তুমুল আপত্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তাদেরকে ফ্যাসিবাদের দোসর বলেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ফারুকী ছিলেন এক সময় শাহবাগী। সেখ বশির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যায় মামলা রয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও তারা কিভাবে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেলেন? তা নিয়ে বিস্মিত খোদ ছাত্র সমাজই।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম তো সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন, ফারুকীরা কীভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে? আন্দোলনের সময়ে নীরব থেকে নিজের গা বাঁচিয়ে চলা লোকদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চান না তারা।

ফারুকী ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য তোষামোদি করেছে উল্লেখ করে সারজিস বলেন, ‘আমরা দেখেছি ফারুকীকে বিগত এই ৩৬ জুলাই কোন সময়ে সরাসরি সরকারের বিপক্ষে গিয়ে এই ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছে তাদের পক্ষে কখনও অবস্থান নেননি। তিনি তার পুরো সময়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার জন্য যেখানে তার মতো করে তুষামদি করা দরকার সেভাবে করেছে।’

‘হতে পারে একটা লাইন লিখে, হতে পারে একটা ছবি তুলে। সবাই এক কাতারে ভাই ভাই সহমত ভাই বলে তোষামোদি করবে না। কেউ একটা লাইন লিখে কেউ একটা শব্দ বলে তোষামোদি করে। এই ফারুকীরা কীভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে? আমাদের জায়গা থেকে আমরা সেদিন স্পষ্ট করে বিরোধিতা জানিয়েছি। আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলি, এরকম নীরব থাকা কঠিন সময়ে নিজের গা বাঁচিয়ে চলা লোকদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চাই না। তারা কোনোদিন আন্দোলনের স্পিরিটকে ধারণ করতে পারে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ফারুকী এবং সেখ বশির উদ্দিনের অপসারণ চেয়ে আন্দোলনেরও ঘোষণা দিয়েছে। সুতরাং, এখানে স্পষ্ট এই উপদেষ্টাদেরও ছাত্ররা নিয়োগ দেয়নি। এমকি বলা যায়, সরকারে ভেতরে থেকেও উপদেষ্টা নিয়োগে নিজেদের ভূমিকা রাখারও সুযোগ পাননি তারা।

ফারুকী কিংবা বশির- এদের নিয়োগের পরপরই প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের নিয়োগ কর্তা কে? তাদের উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হওয়ার পরই সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবারই প্রশ্ন, এমন ধরনের মানুষ কিভাবে উপদেষ্টা পরিষদে আসে?

সারজিস আলমের মতোই দেশের মুক্তিকামী জনতার একটাই বক্তব্য, যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্পিরিটই ধারণ করেন না, তারা কিভাবে সরকার পরিচালনায় উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হন? এ ধরনের লোকদের নিয়োগে কোন অপশক্তি সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে, তাদের চিহ্নিত করা সময়ের দাবি। না হয়, বিপ্লব যেটুকু বেহাত হয়েছে, সেটা শতভাগ বেহাত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশের পরিস্থিতি আপাতত যেন সেদিকেই যাচ্ছে। কড়া নজর রাখা খুব জরুরি।

shomoerkotha@gmail.com
facebook.com/shomoyerkotha

জনপ্রিয় ক্যাটাগরি

জনপ্রিয় সংবাদ