৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর দিনে জনস্রোতে মিশে থাকা লেখক, আলী আহসান জোনায়েদ
৫ আগস্ট লংমার্চ টু ঢাকা, গণভবন ঘেরাও। আন্দোলন তুঙ্গে। টেলিগ্রাম গ্রুপে খোজ নিলাম কারা কীভাবে কখন আসতেছেন। এরপর বেশ কয়েক জায়গায় কথা বললাম। সকালে আসার জন্য তাগাদা দিলাম। রাতভর টেনশন। অনলাইন মিটিং।
সকালে উঠে অপেক্ষায় আছি কখন বেরুবো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কল করলাম কয়েকজনকে। সকালে মেয়েদের কয়েকজন বের হয়েছেন জানলাম। বাসা থেকে বের হলাম ৯টার দিকে। পথিমধ্যে দেখা আরেফিন ভাই, সিবগাতুল্লাহ, সুমনসহ কয়েকজনের সাথে। হাউজিং থেকে রিক্সা নিলাম। সিদ্ধিরগঞ্জ পুল হয়ে দশপাইপের পাশ দিয়ে আসলাম জালকুড়ি। সেখান থেকে আবার রিক্সায় সাইনবোর্ড আসলাম। তারপর ভিতরের রোডে ঢুকলাম। তখনও রাস্তা সুনসান, কাউকে দেখছিনা। আমরা কেবল কয়েকজন। দেখা হলো ঢাবির ৩ জনের সাথে। ওরাও আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়েছে। ওদের পার হয়ে সামনে এসে ভিতরে একটা দোকানে সকালের হালকা নাস্তা করলাম। টেনশন কাজ করছে, এলাকায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আছে। এরমধ্যে আবার রিক্সা নিয়ে আসলাম সাদ্দাম মার্কেট। এভাবে দুইঘন্টা হয়ে গেছে, হাটছি, রিক্সায় উঠছি, গলিপথে ঢুকছি। কিন্তু লোকজন দেখছি না তেমন। তবে কী আজ আমরা ব্যর্থ হবো? কেউ নামবে না? দেশটা কী আর বাঁচবে না? এত রক্ত, সেক্রিফাইস সব বৃথা যাবে? মাথায় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল।
ভাবতে ভাবতেই দেখলাম একটা বিশাল মিছিলে চার-পাঁচশ মেয়ে আর হাজারখানেক ছেলে। দেখামাত্র কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো, পেলাম সাহস। সব ভয়-আশঙ্কা কেটে গেলো। যোগ দিলাম মিছিলে। রায়েরবাগ পর্যন্ত হাটতেই দেখি লক্ষ মানুষ। শনির আখড়া লোকে লোকারণ্য। আসলাম কাজলা ফুটওভার ব্রিজের ওখানে। আমার ছোটভাই জাওয়াদ, মুয়াজসহ সবাই রাজপথে তখন। লাখো লাখো মানুষ নেমে পড়েছে দেশ বাঁচাতে, ফ্যাসিবাদ হটাতে। সবাই সাহস আর দেশপ্রেমে উদ্বেলিত। চিনি না কাউকে, তবু রাজপথে একজন আরেকজনের কত আপন মনে হয়। একসারি লোক এগুচ্ছে যাত্রাবাড়ীর দিকে, গুলি খাচ্ছে, পিছু হটছে। আবার আরেকসারি লোকজন এগুচ্ছে। কেউ থামছে না, এযেন মৃত্যুকে কেয়ার না করার সংকল্পে মেতেছে সবাই। মিরাকল, পিউর মিরাকল। এটা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেন না।
গোলাগুলির মধ্যেই অনাবিল হাসপাতালের গলিতে অবস্থান নিয়েছি আমরাসহ অনেকে। গলির মাথায় আসলেই কোথা থেকে গুলি এসে মাথায় লাগছে কারো না কারো। স্নাইপার শট, হেডশট। একের পর এক। এভাবে চলছে যুদ্ধ। অনাবিল হাসপাতালে একজন একজন করে পনেরজন সহযোদ্ধাকে চোখের সামনে হেডশটে আক্রান্ত হয়ে নিয়ে আসতে দেখলাম। আহতদের আনার সুবিধার্থে রাস্তা খালি করা, হাসপাতালে দ্রুত সেবার জন্য সবাই মিলে কাজ করতে লাগলাম। মাথায় গুলিবিদ্ধ ভাই-বোনদের অবস্থা দেখে আমরা সবাই কাঁদছি, সবার চোখে পানি আর চোয়াল শক্ত। এ লড়াই ছাড়বো না। মরে যাবো, তবুও পিছপা হবো না। এমনই প্রতিজ্ঞা সবার।
এরমধ্যেই যোহর আদায় করে নিলাম। ২টায় সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবেন শুনে অনেকেই খুশিতে মাতোয়ারা। গুজব ছড়ালো, হাসিনা নাই। কেউ কেউ এটা শুনে সেজদা দিতে লাগলো, কোলাকুলি কর্তে লাগলো। আর্মির নামে শ্লোগান দিতে লাগলো। কিন্তু আমি ফোনে জানলাম যে সেনাপ্রধানের বক্তব্য একঘন্টা পেছানো হয়েছে। ইন্টারনেট তখন স্লো ছিলো। তেমন খবরও জানতে পারছিলাম না। অনাবিল হাসপাতালের হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘোষণা দিতে লাগলাম, কেউ যাবেন না, রাজপথ কেউ ছাড়বেন না। দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি। আমরা সেনাশাসন চাই না। বলতে লাগলাম। এরমধ্যেই খবর পেলাম, হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়েছে। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবারের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো এলাকা। শ্লোগান দিতে লাগলাম। কোলাকুলি, সিজদা। কাঁদতে লাগলাম।
যাত্রাবাড়ীতে তখনো পুরোদমে গুলাগুলি চলছে। হাসিনা পালালেও পুলিশ এখানে মানুষ হত্যা করে গেছে।
কত রক্ত আর কত ত্যাগের ফলে পেলাম বাংলাদেশ, নতুন বাংলাদেশ।
এরপরের গল্প অন্যরকম। নিউজ ২৪, ধানমণ্ডি, রাষ্ট্রগঠন, নানা স্টেকহোল্ডার, আলাপ-আলোচনা, দূরত্ব, কতকিছু। আরেকদিন বলবো এসবের বিস্তারিত। জাতির জন্য কিছু করতেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জড়িয়েছিলাম। জানটা দিতে পারলাম না। আমার ভাই-বোনেরা জীবন দিয়ে, হাত-পা-চোখ হারিয়ে এগিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম, হাসিনা পালালে বিশ্রাম নিবো, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিবো আর ক্যারিয়ারে নজর দিবো। পারলাম না। বিশ্রাম, স্থির আর থিতু হতে পারলাম না। দেশের জন্য কিছু কী করতে পারলাম! জানটা দিয়া দেশরে ভালোবাসি, ভালোবাসি দেশের মানুষ। আমি নিজের চোক্ষে দেখছি জীবন দেওয়ার দৃশ্য, সাহস, আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেম। শুধু এইজন্যই পারলাম না থামতে। কিছু করতে পারলাম কই! আমায় মাফ করে দিয়েন।
৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর দিনে জনস্রোতে মিশে থাকা লেখক, আলী আহসান জোনায়েদ
৫ আগস্ট লংমার্চ টু ঢাকা, গণভবন ঘেরাও। আন্দোলন তুঙ্গে। টেলিগ্রাম গ্রুপে খোজ নিলাম কারা কীভাবে কখন আসতেছেন। এরপর বেশ কয়েক জায়গায় কথা বললাম। সকালে আসার জন্য তাগাদা দিলাম। রাতভর টেনশন। অনলাইন মিটিং।
সকালে উঠে অপেক্ষায় আছি কখন বেরুবো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কল করলাম কয়েকজনকে। সকালে মেয়েদের কয়েকজন বের হয়েছেন জানলাম। বাসা থেকে বের হলাম ৯টার দিকে। পথিমধ্যে দেখা আরেফিন ভাই, সিবগাতুল্লাহ, সুমনসহ কয়েকজনের সাথে। হাউজিং থেকে রিক্সা নিলাম। সিদ্ধিরগঞ্জ পুল হয়ে দশপাইপের পাশ দিয়ে আসলাম জালকুড়ি। সেখান থেকে আবার রিক্সায় সাইনবোর্ড আসলাম। তারপর ভিতরের রোডে ঢুকলাম। তখনও রাস্তা সুনসান, কাউকে দেখছিনা। আমরা কেবল কয়েকজন। দেখা হলো ঢাবির ৩ জনের সাথে। ওরাও আন্দোলনে যোগ দিতে বের হয়েছে। ওদের পার হয়ে সামনে এসে ভিতরে একটা দোকানে সকালের হালকা নাস্তা করলাম। টেনশন কাজ করছে, এলাকায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আছে। এরমধ্যে আবার রিক্সা নিয়ে আসলাম সাদ্দাম মার্কেট। এভাবে দুইঘন্টা হয়ে গেছে, হাটছি, রিক্সায় উঠছি, গলিপথে ঢুকছি। কিন্তু লোকজন দেখছি না তেমন। তবে কী আজ আমরা ব্যর্থ হবো? কেউ নামবে না? দেশটা কী আর বাঁচবে না? এত রক্ত, সেক্রিফাইস সব বৃথা যাবে? মাথায় এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল।
ভাবতে ভাবতেই দেখলাম একটা বিশাল মিছিলে চার-পাঁচশ মেয়ে আর হাজারখানেক ছেলে। দেখামাত্র কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো, পেলাম সাহস। সব ভয়-আশঙ্কা কেটে গেলো। যোগ দিলাম মিছিলে। রায়েরবাগ পর্যন্ত হাটতেই দেখি লক্ষ মানুষ। শনির আখড়া লোকে লোকারণ্য। আসলাম কাজলা ফুটওভার ব্রিজের ওখানে। আমার ছোটভাই জাওয়াদ, মুয়াজসহ সবাই রাজপথে তখন। লাখো লাখো মানুষ নেমে পড়েছে দেশ বাঁচাতে, ফ্যাসিবাদ হটাতে। সবাই সাহস আর দেশপ্রেমে উদ্বেলিত। চিনি না কাউকে, তবু রাজপথে একজন আরেকজনের কত আপন মনে হয়। একসারি লোক এগুচ্ছে যাত্রাবাড়ীর দিকে, গুলি খাচ্ছে, পিছু হটছে। আবার আরেকসারি লোকজন এগুচ্ছে। কেউ থামছে না, এযেন মৃত্যুকে কেয়ার না করার সংকল্পে মেতেছে সবাই। মিরাকল, পিউর মিরাকল। এটা না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করতে পারবেন না।
গোলাগুলির মধ্যেই অনাবিল হাসপাতালের গলিতে অবস্থান নিয়েছি আমরাসহ অনেকে। গলির মাথায় আসলেই কোথা থেকে গুলি এসে মাথায় লাগছে কারো না কারো। স্নাইপার শট, হেডশট। একের পর এক। এভাবে চলছে যুদ্ধ। অনাবিল হাসপাতালে একজন একজন করে পনেরজন সহযোদ্ধাকে চোখের সামনে হেডশটে আক্রান্ত হয়ে নিয়ে আসতে দেখলাম। আহতদের আনার সুবিধার্থে রাস্তা খালি করা, হাসপাতালে দ্রুত সেবার জন্য সবাই মিলে কাজ করতে লাগলাম। মাথায় গুলিবিদ্ধ ভাই-বোনদের অবস্থা দেখে আমরা সবাই কাঁদছি, সবার চোখে পানি আর চোয়াল শক্ত। এ লড়াই ছাড়বো না। মরে যাবো, তবুও পিছপা হবো না। এমনই প্রতিজ্ঞা সবার।
এরমধ্যেই যোহর আদায় করে নিলাম। ২টায় সেনাপ্রধান বক্তব্য দিবেন শুনে অনেকেই খুশিতে মাতোয়ারা। গুজব ছড়ালো, হাসিনা নাই। কেউ কেউ এটা শুনে সেজদা দিতে লাগলো, কোলাকুলি কর্তে লাগলো। আর্মির নামে শ্লোগান দিতে লাগলো। কিন্তু আমি ফোনে জানলাম যে সেনাপ্রধানের বক্তব্য একঘন্টা পেছানো হয়েছে। ইন্টারনেট তখন স্লো ছিলো। তেমন খবরও জানতে পারছিলাম না। অনাবিল হাসপাতালের হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘোষণা দিতে লাগলাম, কেউ যাবেন না, রাজপথ কেউ ছাড়বেন না। দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি। আমরা সেনাশাসন চাই না। বলতে লাগলাম। এরমধ্যেই খবর পেলাম, হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়েছে। নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবারের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো এলাকা। শ্লোগান দিতে লাগলাম। কোলাকুলি, সিজদা। কাঁদতে লাগলাম।
যাত্রাবাড়ীতে তখনো পুরোদমে গুলাগুলি চলছে। হাসিনা পালালেও পুলিশ এখানে মানুষ হত্যা করে গেছে।
কত রক্ত আর কত ত্যাগের ফলে পেলাম বাংলাদেশ, নতুন বাংলাদেশ।
এরপরের গল্প অন্যরকম। নিউজ ২৪, ধানমণ্ডি, রাষ্ট্রগঠন, নানা স্টেকহোল্ডার, আলাপ-আলোচনা, দূরত্ব, কতকিছু। আরেকদিন বলবো এসবের বিস্তারিত। জাতির জন্য কিছু করতেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জড়িয়েছিলাম। জানটা দিতে পারলাম না। আমার ভাই-বোনেরা জীবন দিয়ে, হাত-পা-চোখ হারিয়ে এগিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম, হাসিনা পালালে বিশ্রাম নিবো, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিবো আর ক্যারিয়ারে নজর দিবো। পারলাম না। বিশ্রাম, স্থির আর থিতু হতে পারলাম না। দেশের জন্য কিছু কী করতে পারলাম! জানটা দিয়া দেশরে ভালোবাসি, ভালোবাসি দেশের মানুষ। আমি নিজের চোক্ষে দেখছি জীবন দেওয়ার দৃশ্য, সাহস, আত্মত্যাগ আর দেশপ্রেম। শুধু এইজন্যই পারলাম না থামতে। কিছু করতে পারলাম কই! আমায় মাফ করে দিয়েন।