ঢাকা: মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Follow :

31°C
ঢাকা মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

হঠাৎ কেন সাদিক কায়েমকে ছাত্রলীগ প্রমাণে উঠে-পড়ে লাগলেন নাহিদ-কাদেররা? পেছনের কারণ কী?

সময়ের কথা সম্পাদকীয় ৪ আগস্ট ২০২৫, সোমবার, ১০:০৯ ৬ মিনিটে পড়ুন

দুই হাজার চব্বিশে এর জুলাই আন্দোলনে যে যত বড় মাস্টার মাইন্ডই হোন না কেন, মূল পোস্টার বয় ছিলেন কিন্তু একজন। তিনি নাহিদ ইসলাম। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া, গ্রেফতার-নির্যাতন, রিমান্ড- সবই হজম করেছেন তিনি। নাহিদ ইসলামকে গুম করার পর তাকে মেরে রক্তাক্ত করে পূর্বাচলে ফেলে রাখার ঘটনা ঘটেছিল। এরপর চিকিৎসাধীন হিসেবে ডিবির হাতে গ্রেফতার হলেন। ডিবি হেফাজতে ছিলেন কয়েকদিন। এরপর ছাড়া পেলেন এবং ৩ আগস্ট ঘোষণা করলেন সেই ঐতিহাসিক হাসিনার পদত্যাগের এক দফা।

এই এক দফা ঘোষণার পরই নিশ্চিত হয়ে যায়, হাসির পতন অনিবার্য। ৫ আগস্ট যার পূর্ণতা পেয়েছিল গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। অর্থ্যাৎ, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানের মূল নেতৃত্ব ছিল নাহিদ ইসলামের কাঁধেই। তার সঙ্গে সমন্বয়ক ছিলেন অনেকে। এর মধ্যে অন্যতম আবদুল কাদের। যার নামে পাঠানো হয়েছিল ঐতিহাসিক ৯ দফা। তবে, এই ৯ দফার রচয়িতা কে ছিলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। যদিও এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত যে, তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম, সেক্রেটারি এসএম ফরহাদ এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সিবগাতুল্লাহ সিবগা এই ৯ দফা রচনা করে আবদুল কাদেরকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মিডিয়াতে। যা আবদুল কাদের ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর এক ফেসবুক পোস্টে আংশিক স্বীকারও করেছিলেন।

এরপর আসে কথিত সব মাস্টারমাইন্ডরা। যার পেছনে থেকে আন্দোলনের কলকাঠি নেড়েছেন, গতিপথ তৈরি করেছেন। সেই মাস্টার মাইন্ডরা না থাকলে হয়তো নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব কোনোভাবেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে সফল করতে পারতো না। বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে শুরুতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আন্দোলনের প্রতিটি `পুঁতি‘কে নাকি তিনি এক সুতোয় গেঁথেছেন। এরপর তার বৃদ্ধিবৃত্তিক কথা-বার্তার ফলে মনে হলো, আসলেই দারুণ ইন্টেলেকচুয়াল একটি ছেলে (সত্যিই তাই) এই মাহফুজ আলম। বুদ্ধিজীবী সমাজে দ্রুতই জায়গা করে নিলেন এই মাহফুজ আলম। প্রধান উপদেষ্ঠা ড. ইউনূসও তাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর উপদেষ্টা।

কিন্তু ধীরে ধীরে আন্দোলনের ভেতরের অনেক কিছুই উন্মোচিত হতে শুরু করলো। মানুষের জিজ্ঞাসার জবাবও আসতে শুরু করলো। মানুষ জানতে চায়, সমন্বয়করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে- সবই সত্য; কিন্তু সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে কে? ১৮-১৯ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে হল খালি করে দেয়া হলো, প্রথমসারির সমন্বয়কদের গ্রেফতার করা হলো, তখন এই আন্দোলনকে টেনে নিয়ে গেলো কারা? সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করে আন্দোলনে টেনে আনার কাজ করেছে কারা? এসব তো আর এমনি এমনি হয়নি! নিশ্চয় ভেতর থেকে কেউ এটা নিয়ে কাজ করেছে।

জানা গেলো, সারা দেশে আন্দোলনের সমন্বয়, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, আন্দোলনকে হারিয়ে যেতে না দেয়া, নানা প্রচার-প্রোপাগান্ডায় যেন আন্দোলন দিক না হারায়- এসবের পেছন থেকে শক্ত `মেরুদন্ডে‘র মতো কাজ করেছে ছাত্র শিবির। যার নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম। ঢাবি শিবিরকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে কেন্দ্রীয় শিবির এবং তাদের নির্দেশে সারা দেশের শিবিরের সমস্ত জনশক্তি। শুধু সাদিক কায়েমই নন, নেপথ্যে আরও ভূমিকা রেখেছিলেন এসএম ফরহাদ, শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সিবগাতুল্লাহ সিবগা থেকে শুরু করে অনেকেই।

সাংগঠনিকভাবে এতটা সংগঠিত আকারে ছাত্রদল আন্দোলনে ভূমিকা না রাখলেও, বৃহৎ এই ছাত্র সংগঠনটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মুরুব্বি সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলাম ও বিএনপিও পেছন থেকে শক্ত খুঁটির মত আগলে রেখেছিল এই আন্দোলনকে। হাঙ্গেরি প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের জানিয়েছেন, কিভাবে সমন্বয়কদের জন্য সেফ হাউজ তৈরি করে তাদরেকে সুরক্ষা দেয়া, কিভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি, ঘোষণা এবং বাস্তবায়নে নেপথ্যের ভূমিকা রেখেছেন সাদিক কায়েম তার পুরো বিস্তারিত। নানা জনের নানা ঘটনা এবং জবানিতে এসবই উঠে এসেছে। ৯ দফার সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত আবদুল কাদের গত বছর বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নিজের দেয়া এক ফেসবুক পোস্টে এসব কথা স্বীকার করেছিলেন (তখনও রাজনীতির জটিল সমীকরণে প্রবেশ করেননি কাদের। যখন এসব সমীকরণে প্রবেশ করে ফেলেছিলেন, তখন তার বক্তব্য সম্পূর্ণ উল্টে গেলো)।

পোস্টার বয় নাহিদ ইসলাম ৮ আগস্ট শপথ নেয়া সরকারের অংশ হয়ে গেলেন। বিপ্লবোত্তর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হলেন আইসিটি ও তথ্য মন্ত্রী। আবার মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে এসে গঠন করলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। হলেন দলের প্রধান।

নাহিদ ইসলাম শান্ত, ধীর-স্থির এবং সুবুদ্ধি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন, পরিস্থিতি সামাল দেন। কথা-বার্তায়ও বেশ সংযত মনে হয় তাকে। নাহিদের মধ্যে ভবিষ্যতের একজন মেধাবী, বিচক্ষণ নেতৃত্বের গুণাবলীয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।

তবে তিনি কেন হঠাৎ করে, আন্দোলনের এক পেছনের নায়ক, যাকে বলা হচ্ছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি, সেই সাদিক কায়েমের পেছনে লাগতে? শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনটি বৃহৎ পক্ষকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। কেন তিনি এমনটা করতে গেলেন? কেন এত শান্ত, ধীরস্থির বুদ্ধিসম্পন্ন একজন বিচক্ষণ নেতা হঠাৎ এভাবে ক্ষেপে গেলেন। শুধু সাদিক কায়েমকে নয়, নাহিদ ইসলাম প্রতিপক্ষ বানালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং হাঙ্গেরি প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরকে। যিনি বেশ প্রভাবশালী একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ নামে জুলাই মাসজুড়ে সারাদেশ সফর করেছে। জেলায় জেলায় গিয়েছে। পথসভা, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বা পদযাত্রা- যাই বলি না কেন, সবই করেছে। আবার ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর যে নারকীয় হামলা হয়েছিল, সে সময় তাদেরকে নিয়ে পুরো দেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

নাহিদ, হাসনাত, সার্জিসরা একটি দল গঠন করে আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হয়ে গেলেও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খুনি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় এখনও তাদের প্রতি শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিএনপি-জামায়াত থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সব রাজনৈতিক দলেরও একটা সমর্থন এবং সফট কর্ণার তাদের প্রতি রয়েছে। গোপালগঞ্জে তাদের ওপর হামলা হওয়ার পর সারাদেশে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি-ছাত্রদল উদ্বিগ্ন হয়েছে, তাদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

এরই মাঝে জুলাই আন্দোলনের কৃতিত্ব ভাগাভাগি শুরু করে দিয়েছিলেন বেশ কিছু সমন্বয়ক। ছাত্র শিবিরকে যতভাবে পারা যায়, ততভাবে কোনঠাসা করার জন্য নানান ন্যারেটিভ হাজির করতে শুরু করে ছাত্রদল কিছু সমন্বয়ক। যাদের মধ্যে যোগ দিলেন আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার, মাহিন সরকারসহ অনেকে। বিশেষ করে আবদুল কাদের। ৯ দফা যার নামে প্রচার হয়েছিল; কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি টেনে এনে ছাত্র শিবিরকে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িয়ে প্রচার-প্রোপাগান্ডা শুরু করেছেন এই সমন্বয়ক।

কিন্তু শিবির কখনো বলেনি, জুলাই আন্দোলন তাদের একার বা তারা অনেক কিছু করে ফেলেছে। মূলতঃ সাদিক কায়েম নিজেকে যখন ঢাবি শিবির সভাপতি হিসেবে প্রকাশ করলেন, তখন উল্লিখিত সংগঠন এবং ব্যক্তিদের ওপর থেকে পুরো লাইমলাইট সরে যাওয়ার জোগাড় হয়। যার কারণে, নিজেদের ওপর ফোকাস ঠিক রাখতে নানা মনগড়া ন্যারেটিভ তৈরি করতে শুরু করে তারা। ছাত্রদলের সভাপকি রাকিবুল ইসলাম, সেক্রেটারি নাসিরুদ্দিন নাসির অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকে শিবির দমানোর জন্য।

এরফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো, জুলাই আন্দোলনের ফলে যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, সে ঐক্য ভেঙে গেলো। ফ্যাসিবাদীরা এটাই চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, যে মজবুত ঐক্যের ভিত্তিতে তাদের পতন ঘটানো হয়েছে, সবার আগে সেই ঐক্য বিনষ্ট করতে হবে। সে কারণে, ফ্যাসিস্টরাও পেছন থেকে নানা উপায়ে ছাত্রদল, আবদুল কাদের, মাহিন সরকারদের তৈরি করা পালে তুমুল বেগে হাওয়া দিতে থাকলো। সুতরাং, সবাই যখন দেশ গঠনে মনযোগী হওয়ার কথা, তখন তারা লিপ্ত হলো পরস্পরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়িতে।

কিন্তু শিবির এসব পঙ্কিলতাকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের পথ নির্মাণেই ব্যস্ত। তারা তাদের প্রথা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে। সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতির ধারার প্রবর্তন হোক- এটা সবাই চায়। শিবিরি এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, এ বিশ্বাস সাধারণ শিক্ষার্থদের মধ্যে বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে। এমনকি নারী শিক্ষার্থীরাও আস্থা রাখতে শুরু করেছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় শিবিরের নাম নেয়া ছিল মৃত্যু পরোয়ানায় নাম ওঠানোর মত অপরাধ, এখন সেখানে শিবির প্রকাশ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব সহ্য করার মত নয় ছাত্রদল, নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগ এবং বাম সংগঠনগুলোর। যার ফলে এতদিন নানা ছলে-বলে, কৌশলে শিবির বিরোধী ন্যারেটিভ তৈরি করে যাচ্ছিল তারা।

এভাবেই হয়তো ছাত্র রাজনীতি এগিয়ে যেতে থাকতো আরও বেশ কিছুদিন; কিন্তু চূড়ান্ত সময়টা যেন হাজির হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ ঢাকসু, ১১ তারিখ জাকসু এবং ১৫ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে রাকসু নির্বাচন। এখন এই তিন ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই ছাত্ররাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। বিশেষ করে ঢাকসুতে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছে ছাত্রশিবিরি। বিশেষ করে সাদিক কায়েম এবং এসএম ফরহাদদের কারণে। ব্যক্তি হিসেবে সাদিক কায়েম এখন ঢাবি ক্যাম্পাসে সর্বজন গ্রহণযোগ্য এক ছাত্রনেতা। সঙ্গে রয়েছেন এসএম ফরহাদ, মহিউদ্দিন আহমদরা। ঢাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে, কারা কারা প্যানেল দিতে পারে। কোন প্যানেলে কে থাকবে? এসব নিয়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম এখন নেই। সেটা ভেঙে হয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)। এই সংগঠনের ব্যানারে আবদুল কাদের, মাহিন সরকার এবং আবু বাকের মজুমদাররা সক্রিয়, সংগঠিত। এরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ তথা ঢাকসুর নির্বাচনে শক্তিশালী প্যানেল তৈরির চেষ্টা করছে। বাগছাসকে সামনে রেখে ছক কষতে শুরু করেছে জুলাই গণ অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দল এনসিপি। দলটির নেতারা বাগছাসের নেতাদের ঢাকসুতে দেখতে চান। সে হিসেবে ছক কষে পা ফেলতে চাচ্ছেন তারা।

কিন্তু সবার নজর ছাত্র শিবিরের দিকে। তারা কী করে, কোন প্যানেল দাঁড় করায়- এটাই ছিল দেখার। অবশেষে যখন সম্ভাবনা দেখা দিলো, সাদিক কায়েম-এসএম ফরহাদরা একটি প্যানেল নিয়ে ঢাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন, তখন অনেকেরই মাথা ঘুরে গেলো। এনসিপি নেতারা দেখলো সামনে আর পথ খোলা নেই। আবদুল কাদের, মাহিন সরকারদের প্যানেলের হয়তো বা ভরাডুবি ঘটতে পারে। সাদিক কায়েমদের যে জনপ্রিয়তা ঢাবি ক্যাম্পাসে, তাতে আবদুল কাদেরদের কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে জ্বল্পনা-কল্পনা শুরু হওয়ার পরই পরিবেশ পাল্টাতে থাকে।

যার প্রভাব পুরোপুরি পড়েছে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান হিসেবে পরিচিত নাহিদ ইসলামের ওপর। তাদের এখন একটাই এজেন্ডা, কিভাবে সাদিক কায়েমকে ছোট করে উপস্থাপন করা যায়। কিভাবে সাদিক কায়েমের পক্ষে তৈরি হওয়া সব ন্যারেটিভ ভেঙে ফেলা যায়। এ কারণে, কয়েকদিন আগে জুলাই আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা সম্পর্ক ফেসবুকে লিখেছিলেন সাদিক কায়েম। এটাকে পুঁজি করেই নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনটি পয়েন্টে কথা বললেন নাহিদ ইসলাম। প্রথমে মির্জা ফখরুল ও তারেক রহমান সম্পর্কে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকার গঠন আলোচনা হয়েছে কী হয়নি, সে সম্পর্কে কথা বললেন।

এরপর এলো সাদিক কায়েম প্রসঙ্গ। নাহিদ দাবি করছেন, নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে সাদিক মিথ্যাচার করেছেন। আন্দোলনে শিবিরের অবদানকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন তিনি। নাহিদ ইসলামের যদি মনেই হয় যে, সাদিক কায়েম নিজেকে মিথ্যা সমন্বয়ক দাবি করছেন, তাহলে তিনি একটি বছর কেন এ নিয়ে কথা বলেননি। এখন কেন হঠাৎ এই দাবি নিয়ে হাজির হলেন?

মূলতঃ এর পেছনে রয়েছে ঢাকসু নির্বাচন। সাদিক কায়েমরা এখনও প্যানেল প্রকাশ করেননি। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা আছে জোরালো। ফলে নাহিদ ইসলামরা পর্যন্ত মাঠে নেমে গেছেন শিবির নেতার চরিত্র হননে। এরপর দেখা যাচ্ছে, আবদুল কাদের, মাহিন সরকাররাও ঘৃণ্যভাবে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হওয়া সাদিক কায়েমদের চরিত্র হনন করছে। ফ্যাসিস্ট আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বানিয়ে দিচ্ছে ছাত্রলীগার। ফেসবুকে পোস্ট করা দীর্ঘ স্ট্যটাসে নানাভাবে শিবিরকে ছাত্রলীগার প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আবদুল কাদের। ঢাকসু নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, তত এই প্রোপাগান্ডা বাড়তে থাকবে।

জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আবদুল কাদের, মাহিন সরকার, আবু বাকের মজুমদার কিংবা নাহিদ ইসলামদের প্রতি এখনও ভালোবাসা, সহমর্মিতা রয়েছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু নানা মিথ্যাচারের মাধ্যমে হীন ব্যক্তিস্বার্থে বিভাজন তৈরি করা তাদের পক্ষ থেকে কেউ আশা করে না। আন্দোলনের সিপাহসালার হিসেবে এ বিষয়টা অন্তত ভালোভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন নাহিদ ইসলাম- এ আশা করতেই পারি আমরা।

 

জনপ্রিয় বিষয়

জনপ্রিয় সংবাদ

হঠাৎ কেন সাদিক কায়েমকে ছাত্রলীগ প্রমাণে উঠে-পড়ে লাগলেন নাহিদ-কাদেররা? পেছনের কারণ কী?

দুই হাজার চব্বিশে এর জুলাই আন্দোলনে যে যত বড় মাস্টার মাইন্ডই হোন না কেন, মূল পোস্টার বয় ছিলেন কিন্তু একজন। তিনি নাহিদ ইসলাম। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া, গ্রেফতার-নির্যাতন, রিমান্ড- সবই হজম করেছেন তিনি। নাহিদ ইসলামকে গুম করার পর তাকে মেরে রক্তাক্ত করে পূর্বাচলে ফেলে রাখার ঘটনা ঘটেছিল। এরপর চিকিৎসাধীন হিসেবে ডিবির হাতে গ্রেফতার হলেন। ডিবি হেফাজতে ছিলেন কয়েকদিন। এরপর ছাড়া পেলেন এবং ৩ আগস্ট ঘোষণা করলেন সেই ঐতিহাসিক হাসিনার পদত্যাগের এক দফা।

এই এক দফা ঘোষণার পরই নিশ্চিত হয়ে যায়, হাসির পতন অনিবার্য। ৫ আগস্ট যার পূর্ণতা পেয়েছিল গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। অর্থ্যাৎ, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যূত্থানের মূল নেতৃত্ব ছিল নাহিদ ইসলামের কাঁধেই। তার সঙ্গে সমন্বয়ক ছিলেন অনেকে। এর মধ্যে অন্যতম আবদুল কাদের। যার নামে পাঠানো হয়েছিল ঐতিহাসিক ৯ দফা। তবে, এই ৯ দফার রচয়িতা কে ছিলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। যদিও এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত যে, তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম, সেক্রেটারি এসএম ফরহাদ এবং শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সিবগাতুল্লাহ সিবগা এই ৯ দফা রচনা করে আবদুল কাদেরকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মিডিয়াতে। যা আবদুল কাদের ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর এক ফেসবুক পোস্টে আংশিক স্বীকারও করেছিলেন।

এরপর আসে কথিত সব মাস্টারমাইন্ডরা। যার পেছনে থেকে আন্দোলনের কলকাঠি নেড়েছেন, গতিপথ তৈরি করেছেন। সেই মাস্টার মাইন্ডরা না থাকলে হয়তো নাহিদ ইসলামের নেতৃত্ব কোনোভাবেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে সফল করতে পারতো না। বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে শুরুতে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। আন্দোলনের প্রতিটি `পুঁতি‘কে নাকি তিনি এক সুতোয় গেঁথেছেন। এরপর তার বৃদ্ধিবৃত্তিক কথা-বার্তার ফলে মনে হলো, আসলেই দারুণ ইন্টেলেকচুয়াল একটি ছেলে (সত্যিই তাই) এই মাহফুজ আলম। বুদ্ধিজীবী সমাজে দ্রুতই জায়গা করে নিলেন এই মাহফুজ আলম। প্রধান উপদেষ্ঠা ড. ইউনূসও তাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন কর্মকর্তা হিসেবে। এরপর উপদেষ্টা।

কিন্তু ধীরে ধীরে আন্দোলনের ভেতরের অনেক কিছুই উন্মোচিত হতে শুরু করলো। মানুষের জিজ্ঞাসার জবাবও আসতে শুরু করলো। মানুষ জানতে চায়, সমন্বয়করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে- সবই সত্য; কিন্তু সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে কে? ১৮-১৯ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে হল খালি করে দেয়া হলো, প্রথমসারির সমন্বয়কদের গ্রেফতার করা হলো, তখন এই আন্দোলনকে টেনে নিয়ে গেলো কারা? সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমন্বয় করে আন্দোলনে টেনে আনার কাজ করেছে কারা? এসব তো আর এমনি এমনি হয়নি! নিশ্চয় ভেতর থেকে কেউ এটা নিয়ে কাজ করেছে।

জানা গেলো, সারা দেশে আন্দোলনের সমন্বয়, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, আন্দোলনকে হারিয়ে যেতে না দেয়া, নানা প্রচার-প্রোপাগান্ডায় যেন আন্দোলন দিক না হারায়- এসবের পেছন থেকে শক্ত `মেরুদন্ডে‘র মতো কাজ করেছে ছাত্র শিবির। যার নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার ছাত্র শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম। ঢাবি শিবিরকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছে কেন্দ্রীয় শিবির এবং তাদের নির্দেশে সারা দেশের শিবিরের সমস্ত জনশক্তি। শুধু সাদিক কায়েমই নন, নেপথ্যে আরও ভূমিকা রেখেছিলেন এসএম ফরহাদ, শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা সিবগাতুল্লাহ সিবগা থেকে শুরু করে অনেকেই।

সাংগঠনিকভাবে এতটা সংগঠিত আকারে ছাত্রদল আন্দোলনে ভূমিকা না রাখলেও, বৃহৎ এই ছাত্র সংগঠনটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি। মুরুব্বি সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলাম ও বিএনপিও পেছন থেকে শক্ত খুঁটির মত আগলে রেখেছিল এই আন্দোলনকে। হাঙ্গেরি প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের জানিয়েছেন, কিভাবে সমন্বয়কদের জন্য সেফ হাউজ তৈরি করে তাদরেকে সুরক্ষা দেয়া, কিভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি, ঘোষণা এবং বাস্তবায়নে নেপথ্যের ভূমিকা রেখেছেন সাদিক কায়েম তার পুরো বিস্তারিত। নানা জনের নানা ঘটনা এবং জবানিতে এসবই উঠে এসেছে। ৯ দফার সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত আবদুল কাদের গত বছর বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নিজের দেয়া এক ফেসবুক পোস্টে এসব কথা স্বীকার করেছিলেন (তখনও রাজনীতির জটিল সমীকরণে প্রবেশ করেননি কাদের। যখন এসব সমীকরণে প্রবেশ করে ফেলেছিলেন, তখন তার বক্তব্য সম্পূর্ণ উল্টে গেলো)।

পোস্টার বয় নাহিদ ইসলাম ৮ আগস্ট শপথ নেয়া সরকারের অংশ হয়ে গেলেন। বিপ্লবোত্তর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হলেন আইসিটি ও তথ্য মন্ত্রী। আবার মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে এসে গঠন করলেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। হলেন দলের প্রধান।

নাহিদ ইসলাম শান্ত, ধীর-স্থির এবং সুবুদ্ধি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন, পরিস্থিতি সামাল দেন। কথা-বার্তায়ও বেশ সংযত মনে হয় তাকে। নাহিদের মধ্যে ভবিষ্যতের একজন মেধাবী, বিচক্ষণ নেতৃত্বের গুণাবলীয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো।

তবে তিনি কেন হঠাৎ করে, আন্দোলনের এক পেছনের নায়ক, যাকে বলা হচ্ছে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি, সেই সাদিক কায়েমের পেছনে লাগতে? শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে তিনটি বৃহৎ পক্ষকে প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। কেন তিনি এমনটা করতে গেলেন? কেন এত শান্ত, ধীরস্থির বুদ্ধিসম্পন্ন একজন বিচক্ষণ নেতা হঠাৎ এভাবে ক্ষেপে গেলেন। শুধু সাদিক কায়েমকে নয়, নাহিদ ইসলাম প্রতিপক্ষ বানালেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং হাঙ্গেরি প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরকে। যিনি বেশ প্রভাবশালী একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ নামে জুলাই মাসজুড়ে সারাদেশ সফর করেছে। জেলায় জেলায় গিয়েছে। পথসভা, সমাবেশ, মিছিল-মিটিং বা পদযাত্রা- যাই বলি না কেন, সবই করেছে। আবার ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর যে নারকীয় হামলা হয়েছিল, সে সময় তাদেরকে নিয়ে পুরো দেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল।

নাহিদ, হাসনাত, সার্জিসরা একটি দল গঠন করে আলাদা রাজনৈতিক শক্তি হয়ে গেলেও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খুনি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় এখনও তাদের প্রতি শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিএনপি-জামায়াত থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সব রাজনৈতিক দলেরও একটা সমর্থন এবং সফট কর্ণার তাদের প্রতি রয়েছে। গোপালগঞ্জে তাদের ওপর হামলা হওয়ার পর সারাদেশে জামায়াত-শিবির বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি-ছাত্রদল উদ্বিগ্ন হয়েছে, তাদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলার নিন্দা জানিয়েছে।

এরই মাঝে জুলাই আন্দোলনের কৃতিত্ব ভাগাভাগি শুরু করে দিয়েছিলেন বেশ কিছু সমন্বয়ক। ছাত্র শিবিরকে যতভাবে পারা যায়, ততভাবে কোনঠাসা করার জন্য নানান ন্যারেটিভ হাজির করতে শুরু করে ছাত্রদল কিছু সমন্বয়ক। যাদের মধ্যে যোগ দিলেন আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার, মাহিন সরকারসহ অনেকে। বিশেষ করে আবদুল কাদের। ৯ দফা যার নামে প্রচার হয়েছিল; কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি টেনে এনে ছাত্র শিবিরকে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িয়ে প্রচার-প্রোপাগান্ডা শুরু করেছেন এই সমন্বয়ক।

কিন্তু শিবির কখনো বলেনি, জুলাই আন্দোলন তাদের একার বা তারা অনেক কিছু করে ফেলেছে। মূলতঃ সাদিক কায়েম নিজেকে যখন ঢাবি শিবির সভাপতি হিসেবে প্রকাশ করলেন, তখন উল্লিখিত সংগঠন এবং ব্যক্তিদের ওপর থেকে পুরো লাইমলাইট সরে যাওয়ার জোগাড় হয়। যার কারণে, নিজেদের ওপর ফোকাস ঠিক রাখতে নানা মনগড়া ন্যারেটিভ তৈরি করতে শুরু করে তারা। ছাত্রদলের সভাপকি রাকিবুল ইসলাম, সেক্রেটারি নাসিরুদ্দিন নাসির অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে থাকে শিবির দমানোর জন্য।

এরফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হলো, জুলাই আন্দোলনের ফলে যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, সে ঐক্য ভেঙে গেলো। ফ্যাসিবাদীরা এটাই চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল, যে মজবুত ঐক্যের ভিত্তিতে তাদের পতন ঘটানো হয়েছে, সবার আগে সেই ঐক্য বিনষ্ট করতে হবে। সে কারণে, ফ্যাসিস্টরাও পেছন থেকে নানা উপায়ে ছাত্রদল, আবদুল কাদের, মাহিন সরকারদের তৈরি করা পালে তুমুল বেগে হাওয়া দিতে থাকলো। সুতরাং, সবাই যখন দেশ গঠনে মনযোগী হওয়ার কথা, তখন তারা লিপ্ত হলো পরস্পরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়িতে।

কিন্তু শিবির এসব পঙ্কিলতাকে তোয়াক্কা না করে নিজেদের পথ নির্মাণেই ব্যস্ত। তারা তাদের প্রথা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে। সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে শিবিরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্র রাজনীতির ধারার প্রবর্তন হোক- এটা সবাই চায়। শিবিরি এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, এ বিশ্বাস সাধারণ শিক্ষার্থদের মধ্যে বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে। এমনকি নারী শিক্ষার্থীরাও আস্থা রাখতে শুরু করেছে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় শিবিরের নাম নেয়া ছিল মৃত্যু পরোয়ানায় নাম ওঠানোর মত অপরাধ, এখন সেখানে শিবির প্রকাশ্য কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এসব সহ্য করার মত নয় ছাত্রদল, নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগ এবং বাম সংগঠনগুলোর। যার ফলে এতদিন নানা ছলে-বলে, কৌশলে শিবির বিরোধী ন্যারেটিভ তৈরি করে যাচ্ছিল তারা।

এভাবেই হয়তো ছাত্র রাজনীতি এগিয়ে যেতে থাকতো আরও বেশ কিছুদিন; কিন্তু চূড়ান্ত সময়টা যেন হাজির হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ ঢাকসু, ১১ তারিখ জাকসু এবং ১৫ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে রাকসু নির্বাচন। এখন এই তিন ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে ঘিরেই ছাত্ররাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। বিশেষ করে ঢাকসুতে।

৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছে ছাত্রশিবিরি। বিশেষ করে সাদিক কায়েম এবং এসএম ফরহাদদের কারণে। ব্যক্তি হিসেবে সাদিক কায়েম এখন ঢাবি ক্যাম্পাসে সর্বজন গ্রহণযোগ্য এক ছাত্রনেতা। সঙ্গে রয়েছেন এসএম ফরহাদ, মহিউদ্দিন আহমদরা। ঢাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে, কারা কারা প্যানেল দিতে পারে। কোন প্যানেলে কে থাকবে? এসব নিয়ে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম এখন নেই। সেটা ভেঙে হয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)। এই সংগঠনের ব্যানারে আবদুল কাদের, মাহিন সরকার এবং আবু বাকের মজুমদাররা সক্রিয়, সংগঠিত। এরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ তথা ঢাকসুর নির্বাচনে শক্তিশালী প্যানেল তৈরির চেষ্টা করছে। বাগছাসকে সামনে রেখে ছক কষতে শুরু করেছে জুলাই গণ অভ্যুত্থান থেকে জন্ম নেওয়া দল এনসিপি। দলটির নেতারা বাগছাসের নেতাদের ঢাকসুতে দেখতে চান। সে হিসেবে ছক কষে পা ফেলতে চাচ্ছেন তারা।

কিন্তু সবার নজর ছাত্র শিবিরের দিকে। তারা কী করে, কোন প্যানেল দাঁড় করায়- এটাই ছিল দেখার। অবশেষে যখন সম্ভাবনা দেখা দিলো, সাদিক কায়েম-এসএম ফরহাদরা একটি প্যানেল নিয়ে ঢাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন, তখন অনেকেরই মাথা ঘুরে গেলো। এনসিপি নেতারা দেখলো সামনে আর পথ খোলা নেই। আবদুল কাদের, মাহিন সরকারদের প্যানেলের হয়তো বা ভরাডুবি ঘটতে পারে। সাদিক কায়েমদের যে জনপ্রিয়তা ঢাবি ক্যাম্পাসে, তাতে আবদুল কাদেরদের কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে জ্বল্পনা-কল্পনা শুরু হওয়ার পরই পরিবেশ পাল্টাতে থাকে।

যার প্রভাব পুরোপুরি পড়েছে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান হিসেবে পরিচিত নাহিদ ইসলামের ওপর। তাদের এখন একটাই এজেন্ডা, কিভাবে সাদিক কায়েমকে ছোট করে উপস্থাপন করা যায়। কিভাবে সাদিক কায়েমের পক্ষে তৈরি হওয়া সব ন্যারেটিভ ভেঙে ফেলা যায়। এ কারণে, কয়েকদিন আগে জুলাই আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা সম্পর্ক ফেসবুকে লিখেছিলেন সাদিক কায়েম। এটাকে পুঁজি করেই নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনটি পয়েন্টে কথা বললেন নাহিদ ইসলাম। প্রথমে মির্জা ফখরুল ও তারেক রহমান সম্পর্কে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জাতীয় সরকার গঠন আলোচনা হয়েছে কী হয়নি, সে সম্পর্কে কথা বললেন।

এরপর এলো সাদিক কায়েম প্রসঙ্গ। নাহিদ দাবি করছেন, নিজেকে সমন্বয়ক দাবি করে সাদিক মিথ্যাচার করেছেন। আন্দোলনে শিবিরের অবদানকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন তিনি। নাহিদ ইসলামের যদি মনেই হয় যে, সাদিক কায়েম নিজেকে মিথ্যা সমন্বয়ক দাবি করছেন, তাহলে তিনি একটি বছর কেন এ নিয়ে কথা বলেননি। এখন কেন হঠাৎ এই দাবি নিয়ে হাজির হলেন?

মূলতঃ এর পেছনে রয়েছে ঢাকসু নির্বাচন। সাদিক কায়েমরা এখনও প্যানেল প্রকাশ করেননি। তবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা আছে জোরালো। ফলে নাহিদ ইসলামরা পর্যন্ত মাঠে নেমে গেছেন শিবির নেতার চরিত্র হননে। এরপর দেখা যাচ্ছে, আবদুল কাদের, মাহিন সরকাররাও ঘৃণ্যভাবে প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির হওয়া সাদিক কায়েমদের চরিত্র হনন করছে। ফ্যাসিস্ট আমলে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বানিয়ে দিচ্ছে ছাত্রলীগার। ফেসবুকে পোস্ট করা দীর্ঘ স্ট্যটাসে নানাভাবে শিবিরকে ছাত্রলীগার প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আবদুল কাদের। ঢাকসু নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, তত এই প্রোপাগান্ডা বাড়তে থাকবে।

জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আবদুল কাদের, মাহিন সরকার, আবু বাকের মজুমদার কিংবা নাহিদ ইসলামদের প্রতি এখনও ভালোবাসা, সহমর্মিতা রয়েছে সাধারণ মানুষের। কিন্তু নানা মিথ্যাচারের মাধ্যমে হীন ব্যক্তিস্বার্থে বিভাজন তৈরি করা তাদের পক্ষ থেকে কেউ আশা করে না। আন্দোলনের সিপাহসালার হিসেবে এ বিষয়টা অন্তত ভালোভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন নাহিদ ইসলাম- এ আশা করতেই পারি আমরা।

 

জনপ্রিয় ক্যাটাগরি

জনপ্রিয় সংবাদ