ঢাকা: মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Follow :

31°C
ঢাকা মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঋতু-প্রকৃতি

সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে এলো শরৎ

সময়ের কথা নিউজ ১৬ আগস্ট ২০২৫, শনিবার, ১২:১২ ২ মিনিটে পড়ুন

প্রকৃতির যাত্রা আটকে রাখা যায় না। সেই চিরন্তন নিয়মের পথ ধরে বাংলার ঋতুচক্রে আবার এল শরৎ। আজ ভাদ্রের প্রথম দিন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।’ রূপের রানি শরতের আগমন মানেই আকাশে সাদা মেঘ আর স্তিমিত হয়ে আসা রোদের গল্প।

শরতের প্রকৃতি আসলে কেমন? অনেকেই আছেন, যাঁরা শরৎকে আলাদা করে খুঁজে পান না। তাঁদের কাছে শরৎ অদেখা ঋতু। অনুভূতিপ্রবণ প্রকৃতিসখা মানুষের কাছেও কি তাই! হয়তো নয়। আসলে বাংলার প্রকৃতি যেন নিজেই সাজিয়ে তোলে শরৎকালকে।

শরতের সকালগুলো আলাদা এক স্বাদ নিয়ে আসে—ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাস, বাতাসে শিউলির টাটকা সুবাস আর ঘরের আঙিনায় পাতাঝরা নীরবতা। নুয়ে পড়া ধানের শিষ যেন কৃষকের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়।

শিউলি প্রধানত শরতের ফুল। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তোলা

গ্রামের সরু পথের ধারে কিংবা নদীর ধূসর পাড়ে দেখা মেলে সাদা বকের সারি—কখনো ধীরে উড়ে যায়, কখনো থামে মাছের খোঁজে অগভীর জলে। দুপুরের শান্ত সময়ে প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়াউড়ি আনন্দের বার্তা দেয়। কোথাও শোনা যায় ঝিঁঝি পোকার সুর, যা এই ঋতুর শান্তিকে আরও গভীর করে।

এই শরৎ—নির্মল, শান্ত, প্রশান্তির ঋতু। প্রকৃতি এখানে যেন কোনো তাড়াহুড়া জানে না, বরং ধীরে ধীরে, অবসরে, হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় তার অনুপম রূপের কোমল হাতছানি দিয়ে।

শরৎ ঋতুর অন্যতম প্রাপ্তি শিউলি ফুল। রাতে ফোটে, ভোরে ঝরে যায়। ঘ্রাণের রেশ রেখে যায় সারাটা দিন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই তো লিখেছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’

আকাশে শরতের পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ। এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির পরশ মেখে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছে দুই শিশু শিক্ষার্থী। অভিরাম এলাকা, রংপুর

শরৎ ঋতুতেও যেন থেমে থাকে না ফুলের উৎসব। ফোটে মালতী, কলাবতী, দোলনচাঁপা, সেগুন ফুল, বিলেতি জারুল। জলজ ফুলের মধ্যে দেখা যায় শাপলা, শালুক, পদ্ম। এই কদিন আগেও ছিল কৃষ্ণচূড়া, এখন অবশ্য নেই।

ভাদ্র ও আশ্বিন—শরতের দুই মাসেরই যেন আলাদা রূপভঙ্গি। ভাদ্রের আকাশে কখনো ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, আবার কখনো হঠাৎ অসহনীয় গরম। আবহাওয়া অফিস বলছে, একটা লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা রূপ নিতে পারে নিম্নচাপে। এর প্রভাবে রোববার থেকে বাড়তে পারে বৃষ্টি।

গ্রামের মানুষ ভাদ্র মাসকে বলেন ‘তালপাকা ভাদ্র’। মাঠের ধারে পাকা তাল পড়ছে টুপটাপ, বাজারেও উঠেছে সেই সুগন্ধি ফল। একেকটা পাকা তাল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে তালের পিঠা বানানোর আয়োজন—মচমচে তালের বড়া, সুস্বাদু তালের পায়েস আর নরম তুলতুলে তালের পিঠা যেন ভাদ্রেরই স্বাদ-পরিচয়।

শরতের দ্বিতীয় মাস আশ্বিনে সন্ধ্যা নেমে আসে তাড়াতাড়ি। বাতাসে মিশে থাকে হালকা শীতলতার ইঙ্গিত, যেন প্রকৃতি আস্তে আস্তে নিজেকে প্রস্তুত করছে শীতের জন্য। দূর থেকে ভেসে আসে হেমন্তের পদধ্বনি—নীরব, কোমল অথচ স্পষ্ট।

কাশফুলে সেজেছে দুই শিক্ষার্থী

শহরের অনেক মানুষই হয়তো শোনেননি—বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত এক অনন্য লোকাচারের নাম ‘ভাদর কাটানির উৎসব’। বিশ্বাস আছে, ভাদ্র মাসের প্রথম তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে নববধূ যদি স্বামীর মুখ দেখেন, তবে নাকি অমঙ্গল ঘটে। তাই শ্রাবণের শেষ দিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি ফিরে যান নববধূরা—কয়েক দিনের জন্য হলেও শৈশবের আঙিনায় ফেরা যেন।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি রাজিউর রহমান বলছিলেন, একসময় নববধূরা গরু-মহিষের গাড়িতে চড়ে ‘ভাদর কাটানি’তে বাবার বাড়ি যেতেন। এখন সে দৃশ্য বদলে গেছে—গরুর গাড়ির জায়গা নিয়েছে মাইক্রোবাস আর ইজিবাইক।

রাজধানীর ব্যস্ত জীবনে কাশফুলের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ মিলেছে কয়েক বছর ধরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। কাশফুলের টানে যাওয়া যেতে পারে মিরপুর বেড়িবাঁধ, কেরানীগঞ্জ কিংবা মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার দিকে। শাপলাফোটা মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলও হতে পারে ভালো গন্তব্য। অবশ্য এখনো সেখানে কোনো কাশফুল ফোটেনি।

তবে উন্নয়নের বিভ্রমে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এই আনন্দ। দিনে দিনে কমে আসছে নাবাল জমি, কেটে ফেলা হচ্ছে কাশফুলের খেত—প্রকৃতির এই কোমল সৌন্দর্য ধ্বংসে যেন কারও হাত কাঁপে না।

শরৎ হলো বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিত আনন্দের ঋতু, যেখানে প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি ঘ্রাণ আর প্রতিটি দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির অপরূপ স্নেহ আর মমত্বের কথা। এই ঋতুতে যেন জীবন নিজেই একটা সুন্দর কাব্য রচনা করে।

জনপ্রিয় বিষয়

জনপ্রিয় সংবাদ

ঋতু-প্রকৃতি

সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে এলো শরৎ

প্রকৃতির যাত্রা আটকে রাখা যায় না। সেই চিরন্তন নিয়মের পথ ধরে বাংলার ঋতুচক্রে আবার এল শরৎ। আজ ভাদ্রের প্রথম দিন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।’ রূপের রানি শরতের আগমন মানেই আকাশে সাদা মেঘ আর স্তিমিত হয়ে আসা রোদের গল্প।

শরতের প্রকৃতি আসলে কেমন? অনেকেই আছেন, যাঁরা শরৎকে আলাদা করে খুঁজে পান না। তাঁদের কাছে শরৎ অদেখা ঋতু। অনুভূতিপ্রবণ প্রকৃতিসখা মানুষের কাছেও কি তাই! হয়তো নয়। আসলে বাংলার প্রকৃতি যেন নিজেই সাজিয়ে তোলে শরৎকালকে।

শরতের সকালগুলো আলাদা এক স্বাদ নিয়ে আসে—ভোরের শিশিরে ভেজা ঘাস, বাতাসে শিউলির টাটকা সুবাস আর ঘরের আঙিনায় পাতাঝরা নীরবতা। নুয়ে পড়া ধানের শিষ যেন কৃষকের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়।

শিউলি প্রধানত শরতের ফুল। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে তোলা

গ্রামের সরু পথের ধারে কিংবা নদীর ধূসর পাড়ে দেখা মেলে সাদা বকের সারি—কখনো ধীরে উড়ে যায়, কখনো থামে মাছের খোঁজে অগভীর জলে। দুপুরের শান্ত সময়ে প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ ওড়াউড়ি আনন্দের বার্তা দেয়। কোথাও শোনা যায় ঝিঁঝি পোকার সুর, যা এই ঋতুর শান্তিকে আরও গভীর করে।

এই শরৎ—নির্মল, শান্ত, প্রশান্তির ঋতু। প্রকৃতি এখানে যেন কোনো তাড়াহুড়া জানে না, বরং ধীরে ধীরে, অবসরে, হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় তার অনুপম রূপের কোমল হাতছানি দিয়ে।

শরৎ ঋতুর অন্যতম প্রাপ্তি শিউলি ফুল। রাতে ফোটে, ভোরে ঝরে যায়। ঘ্রাণের রেশ রেখে যায় সারাটা দিন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই তো লিখেছেন, ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে।’

আকাশে শরতের পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ। এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির পরশ মেখে বিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছে দুই শিশু শিক্ষার্থী। অভিরাম এলাকা, রংপুর

শরৎ ঋতুতেও যেন থেমে থাকে না ফুলের উৎসব। ফোটে মালতী, কলাবতী, দোলনচাঁপা, সেগুন ফুল, বিলেতি জারুল। জলজ ফুলের মধ্যে দেখা যায় শাপলা, শালুক, পদ্ম। এই কদিন আগেও ছিল কৃষ্ণচূড়া, এখন অবশ্য নেই।

ভাদ্র ও আশ্বিন—শরতের দুই মাসেরই যেন আলাদা রূপভঙ্গি। ভাদ্রের আকাশে কখনো ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, আবার কখনো হঠাৎ অসহনীয় গরম। আবহাওয়া অফিস বলছে, একটা লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা রূপ নিতে পারে নিম্নচাপে। এর প্রভাবে রোববার থেকে বাড়তে পারে বৃষ্টি।

গ্রামের মানুষ ভাদ্র মাসকে বলেন ‘তালপাকা ভাদ্র’। মাঠের ধারে পাকা তাল পড়ছে টুপটাপ, বাজারেও উঠেছে সেই সুগন্ধি ফল। একেকটা পাকা তাল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে তালের পিঠা বানানোর আয়োজন—মচমচে তালের বড়া, সুস্বাদু তালের পায়েস আর নরম তুলতুলে তালের পিঠা যেন ভাদ্রেরই স্বাদ-পরিচয়।

শরতের দ্বিতীয় মাস আশ্বিনে সন্ধ্যা নেমে আসে তাড়াতাড়ি। বাতাসে মিশে থাকে হালকা শীতলতার ইঙ্গিত, যেন প্রকৃতি আস্তে আস্তে নিজেকে প্রস্তুত করছে শীতের জন্য। দূর থেকে ভেসে আসে হেমন্তের পদধ্বনি—নীরব, কোমল অথচ স্পষ্ট।

কাশফুলে সেজেছে দুই শিক্ষার্থী

শহরের অনেক মানুষই হয়তো শোনেননি—বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রচলিত এক অনন্য লোকাচারের নাম ‘ভাদর কাটানির উৎসব’। বিশ্বাস আছে, ভাদ্র মাসের প্রথম তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে নববধূ যদি স্বামীর মুখ দেখেন, তবে নাকি অমঙ্গল ঘটে। তাই শ্রাবণের শেষ দিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি ফিরে যান নববধূরা—কয়েক দিনের জন্য হলেও শৈশবের আঙিনায় ফেরা যেন।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি রাজিউর রহমান বলছিলেন, একসময় নববধূরা গরু-মহিষের গাড়িতে চড়ে ‘ভাদর কাটানি’তে বাবার বাড়ি যেতেন। এখন সে দৃশ্য বদলে গেছে—গরুর গাড়ির জায়গা নিয়েছে মাইক্রোবাস আর ইজিবাইক।

রাজধানীর ব্যস্ত জীবনে কাশফুলের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ মিলেছে কয়েক বছর ধরে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। কাশফুলের টানে যাওয়া যেতে পারে মিরপুর বেড়িবাঁধ, কেরানীগঞ্জ কিংবা মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার দিকে। শাপলাফোটা মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলও হতে পারে ভালো গন্তব্য। অবশ্য এখনো সেখানে কোনো কাশফুল ফোটেনি।

তবে উন্নয়নের বিভ্রমে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির এই আনন্দ। দিনে দিনে কমে আসছে নাবাল জমি, কেটে ফেলা হচ্ছে কাশফুলের খেত—প্রকৃতির এই কোমল সৌন্দর্য ধ্বংসে যেন কারও হাত কাঁপে না।

শরৎ হলো বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিত আনন্দের ঋতু, যেখানে প্রতিটি ছোঁয়া, প্রতিটি ঘ্রাণ আর প্রতিটি দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির অপরূপ স্নেহ আর মমত্বের কথা। এই ঋতুতে যেন জীবন নিজেই একটা সুন্দর কাব্য রচনা করে।

জনপ্রিয় ক্যাটাগরি

জনপ্রিয় সংবাদ