লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন (বীর-উত্তম)
চলে গেলেন গোলামীর চুক্তির প্রতিবাদকারী, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন (বীর-উত্তম) মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর বর্তমান কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের পহরচান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ কাশেম এবং মা মজিদা খাতুন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। তবে, তিনি `বরখাস্ত‘ হয়েছিলেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
জিয়াউদ্দিন ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) মুন্সিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর তিনি বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। মেজর আবু তাহের, মেজর মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারীর সঙ্গে অ্যাবোটাবাদ সেনানিবাস থেকে ২৫ জুলাই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দেবীগড়ে পৌঁছেন এবং ২৭ জুলাই দিল্লি হয়ে ৭ আগস্ট কলকাতায় যান। সেখান থেকেই তাকে জেড ফোর্সের অধীনে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগে ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের এম সি কলেজ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সিলেট শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে এবং ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার পর তাঁকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়।
সরকারি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জিয়া উদ্দিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ছিলেন। সিডিএর দায়িত্ব ছাড়ার পর আমৃত্যু তিনি চট্টগ্রাম নগরীর সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ভিন্নপথে যাত্রা
স্বাধীনতার পর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬তম ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি বিমান বাহিনীর সৈন্য বিদ্রোহ দমন করেন এবং যুদ্ধোত্তর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে অস্থায়ী ব্যাটল স্কুল পরিচালনা করেন।
১৯৭২ সালের আগস্টে ‘হলিডে’ পত্রিকায় “হিডেন প্রাইজ” শিরোনামে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন, যেখানে তিনি সরকারের নীতিনির্ধারণ ও ভারতের সাথে গোপন চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ওই প্রবন্ধের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অসন্তুষ্টি এবং পরে সামরিক চাকরিচ্যুতি ঘটে।
বিপ্লবী জীবনের শুরু
১৯৭৪ সালে কর্নেল জিয়াউদ্দিন আত্মগোপনে গিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন। ওই সময় সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তাকে দেখা যায়। দীর্ঘ দিন আত্মগোপনে থেকে তিনি ১৯৮৯ সালে একটি সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
শেষ জীবন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
সাধারণ জীবনে ফিরে আসার পর তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও রাজনীতি কিংবা সামরিক বাহিনীর সক্রিয়তায় আর ফিরে যাননি, তবে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে স্পষ্টভাষী অবস্থান নিয়েছেন।
একজন অনন্য ইতিহাসপ্রাণ সৈনিক
মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। তার বীরত্বসনদ ছিল ২২ নম্বরে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী যোদ্ধা, যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও রাষ্ট্রের চরিত্র ও অভ্যন্তরীণ ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন থেকে ইতিহাসে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।
গোপন গোলামী চুক্তি এবং লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ের তথ্য
০১.
“… Those who know of such a treaty must tell the people that there is such an act of “betrayal.’ If they do not do it, they are enemies of the people and the freedom fighters have a right to demand it. All outward manifestations of that treaty in any form are trying to guard what belongs to the people. They, too, are enemies of the people. If the Bangabandhu loves his people he must let the people know. Why should he be afraid? We fought without him and won, and now if need be, we will fight again, nothing can beat us. We can be destroyed but not defeated.”
— Hidden Prize / Weekly Holiday, 20 August 1972
০২.
“… এর মধ্যে এক ব্যতিক্রমি ঘটনা ঘটে আর্মিতে। ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ১৯৭২ সালের শেষদিকে নিজের নামে “হিডেন প্রাইজ” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯ মার্চ ১৯৭২ তারিখে ২৫ বছর মেয়াদি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অনেক গোপন শর্ত আছে বলে প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন সেগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ওই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লেখেন, “We fought without him and won, and now if need be, we will fight again.” সে লেখায় তিনি ওই চুক্তি বাতিলের দাবি করেন।
এদিকে আমি ও জিয়াউদ্দিন তখন সেনানিবাসের স্কুল রোডে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। দুজনেই অবিবাহিত এবং ভালো বন্ধু ছিলাম। আমাদের খাওয়া-দাওয়া প্রায়ই একসঙ্গে হতো। তিনি একজন সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার ছিলেন, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। আমার বিশ্লেষণে তিনি একজন তত্ত্বীয় ও দার্শনিক সেনা অফিসার ছিলেন। তিনি বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতি তথা চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো এদের দর্শনে হয়তো প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে এসে তিনি, তাহের ও মঞ্জুর স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন।
আমি যখন তাকে প্রশ্ন করি, ওই প্রবন্ধে লিখিত এতসব তথ্য তিনি কোথা থেকে পেলেন – উত্তরে তিনি আমাকে জানান , জেনারেল ওসমানী তাকে ওইসব তথ্য সরবরাহ করেন এবং তা তিনি বিশ্বাসও করেন॥”
— মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) । এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক ॥ [মাওলা ব্রাদার্স – ফেব্রুয়ারী, ২০০০। পৃ: ৪৫-৪৬]
০৩.
“… ওয়ারেছাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক (জাসদের সুইসাইড স্কোয়াডের শীর্ষ নেতা। কর্ণেল তাহের ও শহীদ বাহারের ভাই। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদ) স্মৃতিচারণ উপলক্ষে বলেন : ” আমার মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে যখন অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে প্রদান করা হয় তখন কর্ণেল ফারুক তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জ ড্রেজারের ডাইরেক্টার। তার বাসায় এক দিন কর্নেল ফারুক একটি ফোক্সওয়াগেন গাড়ী নিয়ে হাজির। ড্যাসবোর্ডে একটি চাইনীজ পিস্তল। সোজাসুজি তিনি কর্নেল তাহেরকে বললেন, ‘স্যার, এ পিস্তল দিয়ে আমি শেখ মুজিবকে হত্যা করবো। আপনি আর কর্নেল জিয়াউদ্দিন দেশ চালাবেন’॥”
(আজকের কাগজ – ১৫ জানুয়ারী, ১৯৯২)
— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় / আবদুল মতিন ॥ [র্র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ৫২]
০৪.
“… ১৯৭৭ সালের মে মাসের ১ম সপ্তাহে আংকারায় বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সেক্রেটারী হিসাবে কর্মরত লে: কর্ণেল (অব:) আবদুল আজিজ পাশা ছুটিতে দেশে ফেরার পথে ইসলামাবাদে যাত্রা বিরতি করেন। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত মেজর বজলুল হুদা এবং পিকিং থেকে আগত লে: কর্ণেল শরিফুল হক ডালিমের সংগে বৈঠকে মিলিত হন। ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাত করার বিষয়টিও আলোচিত হয়। পাশা, ডালিম ও হুদা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা ও সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সংগে গোপনে যোগাযোগ করে একটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করেন। ডালিম এর আগে তেহরানে মেজর নুরের সংগেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাপ্তাহিক হলিডেতে প্রকাশিত পাশার স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বাম পন্থী সরকার গঠন করা এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল।
ডালিম ও পাশা সমমনা সামরিক অফিসার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংগে যোগাযোগ করবেন, সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন করার দায়িত্ব পড়লো লে: কর্ণেল দিদারুল আলম ও লে: কর্ণেল নুরুন্নবী খানের ওপর। মোশাররফ হোসেন ও কাজী মনির হোসনকে বাম পন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সংগে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মনির জগন্নাথ কলেজের বাম পন্থী ছাত্র নেতা ছিলেন এবং মোশাররফ ছিলেন কৃষি ব্যাংকের অফিসার যার সাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের যোগাযোগ ছিল। মাও পন্থী সর্বহারা দলের নেতা লে: কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের সমর্থনের জন্য ডালিম বেশ কয়েকবার জিয়াউদ্দিনের সংগে যোগাযোগ করেন। কিন্তু জিয়াউদ্দিন এ ধরণের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান॥”
— মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি / স্বাধীনতার বাইশ বছর ॥ [কাকলী প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪ । পৃ: ৮০-৮৭]
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন (বীর-উত্তম)
চলে গেলেন গোলামীর চুক্তির প্রতিবাদকারী, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন (বীর-উত্তম) মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বিকেলে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর বর্তমান কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের পহরচান্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মোহাম্মদ কাশেম এবং মা মজিদা খাতুন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জিয়াউদ্দিন (বীর উত্তম) একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। তবে, তিনি `বরখাস্ত‘ হয়েছিলেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
জিয়াউদ্দিন ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) মুন্সিগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর তিনি বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন। মেজর আবু তাহের, মেজর মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ও ক্যাপ্টেন বজলুল গণি পাটোয়ারীর সঙ্গে অ্যাবোটাবাদ সেনানিবাস থেকে ২৫ জুলাই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের দেবীগড়ে পৌঁছেন এবং ২৭ জুলাই দিল্লি হয়ে ৭ আগস্ট কলকাতায় যান। সেখান থেকেই তাকে জেড ফোর্সের অধীনে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগে ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের এম সি কলেজ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যৌথ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সিলেট শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে এবং ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার পর তাঁকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়।
সরকারি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জিয়া উদ্দিন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ছিলেন। সিডিএর দায়িত্ব ছাড়ার পর আমৃত্যু তিনি চট্টগ্রাম নগরীর সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ভিন্নপথে যাত্রা
স্বাধীনতার পর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬তম ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তিনি বিমান বাহিনীর সৈন্য বিদ্রোহ দমন করেন এবং যুদ্ধোত্তর সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে অস্থায়ী ব্যাটল স্কুল পরিচালনা করেন।
১৯৭২ সালের আগস্টে ‘হলিডে’ পত্রিকায় “হিডেন প্রাইজ” শিরোনামে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন, যেখানে তিনি সরকারের নীতিনির্ধারণ ও ভারতের সাথে গোপন চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ওই প্রবন্ধের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অসন্তুষ্টি এবং পরে সামরিক চাকরিচ্যুতি ঘটে।
বিপ্লবী জীবনের শুরু
১৯৭৪ সালে কর্নেল জিয়াউদ্দিন আত্মগোপনে গিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হন। ওই সময় সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তাকে দেখা যায়। দীর্ঘ দিন আত্মগোপনে থেকে তিনি ১৯৮৯ সালে একটি সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
শেষ জীবন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব
সাধারণ জীবনে ফিরে আসার পর তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যদিও রাজনীতি কিংবা সামরিক বাহিনীর সক্রিয়তায় আর ফিরে যাননি, তবে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে স্পষ্টভাষী অবস্থান নিয়েছেন।
একজন অনন্য ইতিহাসপ্রাণ সৈনিক
মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। তার বীরত্বসনদ ছিল ২২ নম্বরে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী যোদ্ধা, যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও রাষ্ট্রের চরিত্র ও অভ্যন্তরীণ ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নে আপসহীন থেকে ইতিহাসে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান নিশ্চিত করেছেন।
গোপন গোলামী চুক্তি এবং লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ের তথ্য
০১.
“… Those who know of such a treaty must tell the people that there is such an act of “betrayal.’ If they do not do it, they are enemies of the people and the freedom fighters have a right to demand it. All outward manifestations of that treaty in any form are trying to guard what belongs to the people. They, too, are enemies of the people. If the Bangabandhu loves his people he must let the people know. Why should he be afraid? We fought without him and won, and now if need be, we will fight again, nothing can beat us. We can be destroyed but not defeated.”
— Hidden Prize / Weekly Holiday, 20 August 1972
০২.
“… এর মধ্যে এক ব্যতিক্রমি ঘটনা ঘটে আর্মিতে। ঢাকা ব্রিগেডের কমান্ডার লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় ১৯৭২ সালের শেষদিকে নিজের নামে “হিডেন প্রাইজ” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯ মার্চ ১৯৭২ তারিখে ২৫ বছর মেয়াদি স্বাক্ষরিত চুক্তিতে অনেক গোপন শর্ত আছে বলে প্রকাশ করেন এবং দাবি করেন সেগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। ওই প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লেখেন, “We fought without him and won, and now if need be, we will fight again.” সে লেখায় তিনি ওই চুক্তি বাতিলের দাবি করেন।
এদিকে আমি ও জিয়াউদ্দিন তখন সেনানিবাসের স্কুল রোডে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। দুজনেই অবিবাহিত এবং ভালো বন্ধু ছিলাম। আমাদের খাওয়া-দাওয়া প্রায়ই একসঙ্গে হতো। তিনি একজন সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক অফিসার ছিলেন, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিল না। আমার বিশ্লেষণে তিনি একজন তত্ত্বীয় ও দার্শনিক সেনা অফিসার ছিলেন। তিনি বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতি তথা চে গুয়েভারা, ফিদেল ক্যাস্ট্রো এদের দর্শনে হয়তো প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান থেকে এসে তিনি, তাহের ও মঞ্জুর স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন।
আমি যখন তাকে প্রশ্ন করি, ওই প্রবন্ধে লিখিত এতসব তথ্য তিনি কোথা থেকে পেলেন – উত্তরে তিনি আমাকে জানান , জেনারেল ওসমানী তাকে ওইসব তথ্য সরবরাহ করেন এবং তা তিনি বিশ্বাসও করেন॥”
— মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) । এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক ॥ [মাওলা ব্রাদার্স – ফেব্রুয়ারী, ২০০০। পৃ: ৪৫-৪৬]
০৩.
“… ওয়ারেছাত হোসেন বেলাল, বীরপ্রতীক (জাসদের সুইসাইড স্কোয়াডের শীর্ষ নেতা। কর্ণেল তাহের ও শহীদ বাহারের ভাই। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদ) স্মৃতিচারণ উপলক্ষে বলেন : ” আমার মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে যখন অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে প্রদান করা হয় তখন কর্ণেল ফারুক তার ব্যাটালিয়ান নিয়ে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জ ড্রেজারের ডাইরেক্টার। তার বাসায় এক দিন কর্নেল ফারুক একটি ফোক্সওয়াগেন গাড়ী নিয়ে হাজির। ড্যাসবোর্ডে একটি চাইনীজ পিস্তল। সোজাসুজি তিনি কর্নেল তাহেরকে বললেন, ‘স্যার, এ পিস্তল দিয়ে আমি শেখ মুজিবকে হত্যা করবো। আপনি আর কর্নেল জিয়াউদ্দিন দেশ চালাবেন’॥”
(আজকের কাগজ – ১৫ জানুয়ারী, ১৯৯২)
— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় / আবদুল মতিন ॥ [র্র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশান্স – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ৫২]
০৪.
“… ১৯৭৭ সালের মে মাসের ১ম সপ্তাহে আংকারায় বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সেক্রেটারী হিসাবে কর্মরত লে: কর্ণেল (অব:) আবদুল আজিজ পাশা ছুটিতে দেশে ফেরার পথে ইসলামাবাদে যাত্রা বিরতি করেন। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত মেজর বজলুল হুদা এবং পিকিং থেকে আগত লে: কর্ণেল শরিফুল হক ডালিমের সংগে বৈঠকে মিলিত হন। ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাত করার বিষয়টিও আলোচিত হয়। পাশা, ডালিম ও হুদা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা ও সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সংগে গোপনে যোগাযোগ করে একটি সশস্ত্র সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করেন। ডালিম এর আগে তেহরানে মেজর নুরের সংগেও এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাপ্তাহিক হলিডেতে প্রকাশিত পাশার স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায় সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বাম পন্থী সরকার গঠন করা এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল।
ডালিম ও পাশা সমমনা সামরিক অফিসার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংগে যোগাযোগ করবেন, সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন করার দায়িত্ব পড়লো লে: কর্ণেল দিদারুল আলম ও লে: কর্ণেল নুরুন্নবী খানের ওপর। মোশাররফ হোসেন ও কাজী মনির হোসনকে বাম পন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সংগে যোগাযোগ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মনির জগন্নাথ কলেজের বাম পন্থী ছাত্র নেতা ছিলেন এবং মোশাররফ ছিলেন কৃষি ব্যাংকের অফিসার যার সাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের যোগাযোগ ছিল। মাও পন্থী সর্বহারা দলের নেতা লে: কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের সমর্থনের জন্য ডালিম বেশ কয়েকবার জিয়াউদ্দিনের সংগে যোগাযোগ করেন। কিন্তু জিয়াউদ্দিন এ ধরণের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান॥”
— মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি / স্বাধীনতার বাইশ বছর ॥ [কাকলী প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪ । পৃ: ৮০-৮৭]